মুশকিলেই পড়েছেন জাহিদুল হাসান। মাস ছয় হয় রুনার সঙ্গে দারুণ এক রসায়ন জমে উঠেছে। অবস্থা এমন, প্রেম হয়েযাওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওদিকে সহপাঠী নীলিমার সঙ্গেও একটা প্রেম প্রেম ভাব চলছে বহুদিন। ব্যাপারটা অনেকদিন হয়ে গেছে। এখন একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার। কার সঙ্গে জড়াবেন? তাঁর যে দুজনকেই ভালো লাগে। কাকে বেশি আরকাকে কম, সেই মীমাংসা করাও প্রায় অসম্ভব। মাঝেমধ্যে একধরনের অপরাধবোধ হয়। একসঙ্গে দুজনকে ভালো লাগা বাভালোবাসা হৃদয়সম্মত হতে পারে, কিন্তু সমাজসম্মত কি?
মীমের সমস্যা আরও গোলমেলে। প্রেম ছিল সিরাজের সঙ্গে। কিশোরীবেলার হুলুস্থুল আবেগের দিন থেকে শুরু। সময় গড়াতেগড়াতে আট বছর স্থায়ী হয়েছিল প্রেমের বয়স। মীমের সত্তাজুড়ে ছিলেন সিরাজ। কিন্তু বছর দুয়েক আগে সম্পর্কটা ভেঙে যায়।প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন মীম। ভয়াবহ সেই ভাঙনের মুখ থেকে তাঁকে ফিরিয়েছিলেন অর্ণব।
এখন ওরা পরস্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সম্প্রতি দুজনের পরিবার থেকে পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা এগোচ্ছে। এর মধ্যে ফের কোথাথেকে এসে হাজির সিরাজ। দুই বছর পর ভুল ভেঙেছে তাঁর। ফোনকল, খুদে বার্তা, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ—সর্বত্র ফিরেআসার আকুতি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসার নিচে, অফিসের নিচে সিরাজের দাঁড়িয়ে থাকা মীমকে বিব্রত করে। একই সঙ্গে উসকেদেয় পুরোনো স্মৃতি, পুরোনো প্রেম। তিনি টের পান, নতুন সম্পর্কে জড়ালেও সিরাজের অস্তিত্ব প্রবলভাবেই থেকে গেছে তাঁরভেতর। নিজেকে তাই খুব অসহায় লাগে। ব্যাপারটা এমন, যেন সিরাজকেও তাঁর চাই, অর্ণবকেও চাই। কী করবেন মীম?
ওপরের ঘটনা দুটোকে কল্পিত মনে করতে পারেন। কিন্তু মোটেই তা নয়। শুধু পাত্র–পাত্রীদের নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছাছাড়ুন। রোহিনীচন্দ্র বর্মণের কথা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই! এই তো মাস দুয়েক আগের কথা। পঞ্চগড়ের এই তরুণ একসঙ্গে দুইপ্রেমিকাকে বিয়ে করে দেশজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, যখন ‘একেও ভালো লাগে, ওকেও ভালো লাগে’ দশায় তাঁর দুই ভালোলাগাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ–সভ্যতার কঠিন বাস্তবতায় এহেন কাজ তো সম্ভব নয়। তা ছাড়া ভালো লাগা বাপ্রেমে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার যে ধারণা, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একসঙ্গে দুজনকে ভালো লাগার কথা তুললেই ‘আগে চরিত্রঠিক করো’ কিংবা ‘বেহায়া মনে লাগাম দাও’ বলে উপদেশমূলক বাণী শুনিয়ে দেন সবাই। তবে কি এটি অপরাধ? বেহায়াপনা? চরিত্রহীনতার লক্ষণ?
মানবমন এক অদ্ভুত জিনিস। এক মানুষের ভেতর বাস করে অনেক মানুষ। ভালো লাগা–মন্দ লাগাও হয় বিচিত্র। ‘তোমার ঘরেবসত করে কয়জনা’ তো চিরকালের অমীমাংসিত প্রশ্ন!
কিন্তু এই জটিলতার সমাধান কী? আমার যে একেও ভালো লাগে, ওকেও ভালো লাগে—এ রকম দোটানায় মার্কিনচলচ্চিত্রাভিনেতা জনি ডেপ সহজ এক সমাধান দিয়েছেন। তাঁর মতে, এমন যদি হয়েই যায়, একসঙ্গে যদি দুজনকে ভালো লেগেইযায়, তাহলে দ্বিতীয়জনকে বেছে নিন। কারণ, প্রথমজনকে সত্যি ভালোবাসলে দ্বিতীয়জনকে ভালোবাসতেন না। কিন্তু এমনসিদ্ধান্তে আসারও সুযোগ আছে কি? বারবারই তো বলা হচ্ছে, কম বা বেশি, সত্যি বা মিথ্যা টাইপ ব্যাপার নয়, নিরেট একই রকমভালো লাগা কাজ করে দুজনের প্রতি। তবে?
মনের এমন গোলমেলে অবস্থায় মনোবিজ্ঞান কী বলে? ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোবিশ্লেষক ওমনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সজীব আবেদিন বলেন, ‘একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসার ক্ষমতা জন্মগত। তা ছাড়া প্রতিটি মানুষইপৃথক বৈশিষ্ট্যযুক্ত। ভালো লাগার কোনো গুণ বা স্বভাব থেকে প্রেম বা ভালোবাসার অনুভূতি দুজনের প্রতিই জন্মাতে পারে।পিটুইটারি গ্রন্থি ও ফিল গুড হরমোনই এ জন্য দায়ী। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যখনই সম্পর্ক বা দাম্পত্যের কথা আসে, তখনই বাধে বিপত্তি।
জটিলতা এড়াতে সমাজ কিছু নিয়ম চালু করে এবং সম্পর্কে জুড়ে দেয় যৌনতা। তবে মনে রাখা দরকার, সম্পর্ক মানেই কিন্তুশরীরসর্বস্ব নয়। শরীরে একজনের হয়ে মনে মনে দুজনের হয়ে থাকাও যা, মন ও শরীর দুইভাবেই দুজনের হয়ে থাকায় তেমনকোনো ফারাক নেই।’ কেউ দুজনকেই ভালোবাসি বললে, তাঁকে ‘মিথ্যা’ বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতাটিও ঠিক নয়। এখানে অবশ্যইসঙ্গের মানুষটির অভিমান বা কষ্টের বিষয়টি আলাদা প্রসঙ্গ। কিন্তু কেউ দুজনকে ভালোবাসার দাবি করলে তা মিথ্যা নয় এবংপ্রকৃতিবিরুদ্ধও নয়। কিন্তু মনে রাখবেন, সম্পর্কে সততা একটা বিরাট বিষয়।
ডা. সজীব বলেন, ‘একাধিকজনের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হলে বাস্তবতার দিকে খেয়াল করুন। সঙ্গীর পছন্দ–অপছন্দ, সামাজিক অবস্থান, বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া প্রভৃতি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। মাথায় রাখুন সঙ্গীর আদর্শ ও বিশ্বাসগত ব্যাপার।আপনার আদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে ঠিক কতটা মেলে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করুন।
তবে ভালো লাগা হয়তো দমিয়ে রাখা যায় না। তাই এমন জটিল কোনো সম্পর্ক স্থায়ী করার আগে অবশ্যই তিন পক্ষের বিশদআলোচনা জরুরি। এতে কেউ হয়তো নিজ থেকেই সরে দাঁড়াবেন। যেমনটি ঘটেছে পঞ্চগড়ের তরুণ রোহিনীচন্দ্র বর্মণেরবেলাতেও। বিয়ের ২২ দিনের মাথায় এক স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁর। মনোবিশ্লেষকদের পরামর্শ তাই, এ ধরনের ঘটনা এড়িয়েচলাই ভালো। তিক্ততার ভেতর দিয়ে সম্পর্ক শেষ হওয়ার চেয়ে আগেই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমন সম্পর্কের ক্ষেত্রেসততাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মনের সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্বে সৎ থাকাটাই জিতিয়ে দিতে পারে আপনাকে।
সূত্র : প্রথম আলো