বিশ্ববিদ্যালয় ও মুসলিম ঐতিহ্য

খালেদুল হক,শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়:

জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-মনন ও সাধনা-বৈভবের শীর্ষস্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। আর পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়েছে মুসলিমদের হাতে।
আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য দলিল-দস্তাবেজও বলে, বিশাল ও অসামান্য এ কীর্তি-অবদান মুসলমানদের। গিনেজ বুকের রেকর্ড অনুসারে, মরক্কোর ফেজ নগরীর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন বা ইউনেস্কোও স্বীকৃতি দিয়েছে, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে মুসলিমরা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন একজন পুণ্যবতী মুসলিম নারী। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০তম বর্ষপূর্তি হয়।
ফাতেমা আল-ফিহরি নামের এক মুসলিম নারী ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর ফেজ নগরে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তার জন্ম ৮০০ সালে তিউনিসিয়ার কারাওইনে।
আল-ফিহরি পরিবার ফেজে আসেন নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে। সেই সূত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সঙ্গে কারাওইন থেকে সমাজের বেশ কিছু লেখকও ফেজে এসে নগরীর পশ্চিমাংশে বসবাস শুরু করেন।
ফাতিমা আল ফিহরি ও তার বোন মরিয়ম আল-ফিহরি উভয়েই ছিলেন সুশিক্ষিত। তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে প্রচুর অর্থ-বিত্ত লাভ করেন।
ফাতিমা তার অংশের সব অর্থ খরচ করেন লেখকদের জন্য সুবিধাসম্পন্ন একটি মসজিদ তৈরির কাজে। ৮৫৯ সালে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কেবল ইবাদতের স্থান না হয়ে এই মসজিদ শিগগিরই হয়ে ওঠে ধর্মীয় নির্দেশনা ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র। ইতালির বোলোনায় যখন প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তারও আগে কারাওইন হয়ে ওঠে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরুতে এটি ছিল ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। পরে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে পারিপার্শ্বিক বিষয়য়াদি পড়ানো হয়। অল্প সময়ে এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। তারা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে ইতিহাস-ভূগোলসহ অনেক বিষয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করতে থাকেন।
ফেজকে তখন বলা হতো, ‘পাশ্চাত্যের বাগদাদ’—‘বাগদাদ অব দ্য ওয়েস্ট’।
এই বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগে মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাবিষয়ক জ্ঞান বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুবিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
পণ্ডিত ইবনে মাইমুন, আল-ইদ্রিসি, ইবনে আরাবি, ইবনে খালদুন, ইবনে খতিব, আল-বিতরুজি (অ্যালপে ট্রেজিয়াম), ইবনে হিরজিহিম ও আল ওয়্যাজ্জেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন।

এ তো গেলো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ক্ষেত্রে মুসলমান বিশ্বের ইতিহাস।
এখন আসি আমাদের বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ক্ষেত্রে মুসলমানদের কি ইতিহাস আছে, প্রত্যেক ছাত্রের প্রথম স্বপ্ন থাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং ‘দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন’ পাশ করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল কোলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপিয় মডেলে।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ছিল উঁচু। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মূলত পশ্চিম বঙ্গের উঁচুতলার হিন্দু সন্তানরা।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ।

১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ।
পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল এই উদ্যোগের একটি অংশ।
বঙ্গভঙ্গের এই সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ছয় বছর। কারণ এর মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু নেতারা প্রবল আন্দোলন করেন এই বঙ্গভঙ্গের। যার ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ হ্রদ হয় ও পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ক্ষতি হয়।
পরক্ষণে মুসলমানদের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন্য তখনকার লর্ড মুসলিম নেতাদের সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। যার ফলে বাংলাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এসংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে উঠে এসেছে, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?
শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন।
পরিতাপের বিষয় হলো আজকে সেই বিশ্ববিদ্যালয় সহ বাংলাদেশের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় এ ইসলামের কোনো কথা বললেই সে হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, রাজাকার, ও আরো কতো কিছু। কিন্তু অন্যান্য চেতনায় বিশ্বাসী, নাস্তিক,বাম সহ সবাই গর্ভের সাথে ইসলামকে কটাক্ষ করেই চলেছে। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য লজ্জাজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের ঐতিহ্য স্বরণ করে চলা উচিৎ।

Leave a Comment