খোয়াজ খিজিরের বাকি কাহিনি

মানুষ এত খারাপ হয় কী করে? জঘন্য হওয়ারও একটা সীমা থাকে। সংবাদপত্রের পাতায় খবরটি দেখলাম। পুত্র আর পুত্রবধূ মিলে রাস্তায় ফেলে গেলেন এক অসুস্থ বৃদ্ধ মাকে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকা এই বয়স্ক নারীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। হুঁশ ফেরার পর তিনি সব খুলে বললেন। জানালেন নিজের ঘরবাড়ি সন্তানের কথা। তারা তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে। তারপর হাসপাতালে না নিয়ে ফেলে রেখে গেছেন রাস্তায়। বলেছেন, তারা আসবেন একটু পরে। সরল বিশ্বাসে বয়স্ক মানুষটি রাস্তায় বসলেন। অপেক্ষায় থাকলেন। তারপর এক সময় জ্ঞান হারালেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলেন স্থানীয় পথচারীরা। চিকিৎসার পর বৃদ্ধার মনে পড়ল সবকিছু। ঘটনাটি বরিশালের। বড় অদ্ভুত সমাজে বাস করছি। সমাজে বসবাসকারী মানুষের চরিত্র বুঝতে খোয়াজ খিজিরের চশমার দরকার নেই। চোখ খুলে তাকালেই এখন সব দেখা যায়। উন্মোচিত হয় মানুষের অমানবিকতা। মানুষ শুধু চিড়িয়াখানার পশুদের সঙ্গে নয়, নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত পরস্পরের সঙ্গেও। আরেকটি ঘটনা পড়লাম পত্রিকায়। এক বৃদ্ধাকে সরকারি ঘর দেওয়ার কথা বলে দলিলে স্বাক্ষর করতে বললেন স্থানীয় মেম্বার। সরল বিশ্বাসে স্বাক্ষর দিলেন বয়স্ক মানুষটি। তারপর বৃদ্ধার শেষ সম্বল বসতভিটা দাবি করলেন মেম্বার। বললেন, দলিলে স্বাক্ষরটি ছিল জমি লিখে দেওয়ার। ঘর পাওয়ার নয়। মেম্বার বৃদ্ধার বসতভিটার দখল দাবি করলেন।

খারাপেরও একটা সীমা থাকে। এখন তার কোনোটাই নেই। মানুষ হারিয়ে ফেলেছে পারিবারিক, সামাজিক শেষ বন্ধনটুকু। নিভে গেছে চক্ষুলজ্জা। করোনাকালে আরও অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ভাইরাস আক্রান্তের পাশে দাঁড়ায়নি পরিবার, সমাজ। যায়নি মৃত মানুষের জানাজায়। টাঙ্গাইলের মধুপুরের বনের পাশের সড়কে এক মাকে রেখে গিয়েছিলেন তার সন্তানরা। সন্দেহ ছিল তিনি করোনায় আক্রান্ত। তখন হাসপাতালে অনেক বিত্তশালী মানুষও মারা গেছেন নিঃসঙ্গ, একাকী। সারা জীবনের অর্জিত সব সম্পদ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। পারেননি বাঁচতে। কাছে পাননি পরিবারের সদস্যদের। একাকী চলে যেতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি বদল হবে। নতুন সূর্য উদয় হবে পৃথিবীতে। দূর হবে মানুষের মনের কালিমা, লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ। বন্ধ হবে হানাহানি, সংঘাত। বাস্তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। শেষ হয়ে গেছে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ। বেড়েছে লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। গোটা বিশ্বকে এখন কঠিন খেসারত দিতে হচ্ছে যুদ্ধের। মহামারি শেষ হয়নি। যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মানুষ স্বার্থের জন্য মুহূর্তের মধ্যে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। জগৎ সংসারে টেনে এনেছে অশান্তির অনল। মানুষই গবেষণা করছে পৃথিবী ধ্বংসের, আবার সেই মানুষই চেষ্টা করছে পৃথিবীর শান্তি ফিরিয়ে আনার। দ্বৈরথ অবস্থানে মানুষ পৃথিবীতে আসে। বেড়ে উঠে মনের ভিতরে নিষ্ঠুরতা লালন করে। বয়সের সঙ্গে তা কমে না।

মানুষ এখন কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে নেয় না। অসত্য আর গুজবের পেছনে ছুটে বেড়ায়। সত্যকে পায়ে মাড়িয়ে চলে। সেই দিন একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ছোটবেলায় মেলায় গিয়েছিলেন, বনমানুষ নাচছে শুনে। ফিরে এসেছেন মার্বেল খেলে। বনমানুষের সন্ধান পাননি। সবই গুজব। গুজব ছড়ানো হয়েছিল মেলায় উপস্থিতি বাড়াতে। এভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছিল চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে। সবাই বেরিয়ে আসুন। মধ্যরাতে অনেকে শুধু ঘর থেকে বের হননি, সাঈদীর জন্য ২০-২২ জন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। একবার মুসলিম বিশ্বে গুজবের শিকার হয়েছিলেন চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং। মুসলিম দেশগুলোতে গুজব ছড়ানো হয় তিনি মুসলমান হয়েছেন। আমেরিকা ছেড়ে বসবাস করছেন মিসরে। অথচ জীবনেও তিনি মিসর যাননি। ঘটনাটি ১৯৮৩ সালের। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের মেইনস্ট্রিম সংবাদপত্রেও খবর বেরিয়েছিল যে, চাঁদে তিনি আজানের ধ্বনি শুনেছেন। তারপর মুসলমান হয়ে আমেরিকা ছেড়েছেন। ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিসরে। ভাগ্যিস সামাজিক মাধ্যম তখন এত শক্তিশালী ছিল না। থাকলে এই খবরের ডালপালা আরও ব্যাপকভাবে ছড়াত। অনেকে হয়তো জীবন দিয়েও বসতেন। নিজের সম্পর্কে কাল্পনিক খবরে বিস্মিত হলেন নিল আর্মস্ট্রং। তিনি বিষয়টি জানালেন আমেরিকান সরকারকে। আমেরিকান সরকার এ নিয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি পাঠাল মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের দূতাবাসকে। অনুরোধ জানাল এই অসত্য প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। এ নিয়ে দিল্লির ইসলামিক সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদ উদ্দিনের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হয়েছিল নিল আর্মস্ট্রংয়ের। গুজব ছড়ানো মুসলমানদের কান্ডে ওয়াহিদ উদ্দিন দুঃখ প্রকাশ করেন। জবাবে নিল আর্মস্ট্রং ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ওয়াহিদ উদ্দিনকে। সামাজিক মাধ্যমে এখনো পুরনো সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গুজবটি প্রচার হয়।

মানুষ কেন গুজব ছড়িয়ে আনন্দ পায় সেই রহস্য নিয়ে একজন বিখ্যাত চিত্রকর ছবি এঁকেছিলেন। এই চিত্রে দেখানো হয়েছে সত্য ও মিথ্যার লড়াই। সত্য ও মিথ্যা দুজন একটি কুয়োতে নামলেন গোসল করতে। কোনোভাবে গোসল করে তাড়াহুড়ো করে মিথ্যা আগেভাগে কুয়ো থেকে উঠে পড়লেন। তারপর সত্যর কাপড়গুলো পরে চলে গেলেন। একটু পর সত্য ভালোভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে কুয়ো থেকে উঠলেন। বিস্ময় নিয়ে দেখলেন গোসলের আগে তার খুলে রাখা কাপড়গুলো নেই। সব কাপড় নিয়ে চলে গেছেন মিথ্যা। কিছুই রেখে যাননি। মিথ্যার এমন কান্ডে বিস্মিত হলেন সত্য। ক্ষুব্ধও হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন মিথ্যাকে কাছে পেলে শোধ নেবেন। উদ্ধার করবেন নিজের কাপড়। ন্যাংটা শরীর নিয়ে সত্য বের হলেন মিথ্যাকে খুঁজতে। মিথ্যা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনোভাবে ধরা দিচ্ছেন না। সত্যও পথচলা থামালেন না। খুঁজতে খুঁজতে এলেন মানুষের দুনিয়াতে। সত্যকে ন্যাংটা অবস্থায় পথ চলতে দেখে মানুষ হাসাহাসি শুরু করল। কেউ জানাল তিরস্কার। আবার কেউ পাগল বলে ঢিল ছুড়ে মারল। মানুষের আচরণে সত্য বিস্মিত হলেন। হতাশ হলেন। কষ্ট পেলেন। তার ধারণা ছিল মানুষ তার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলেন বিপরীত। মানুষের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার পরও সত্যর মাঝে ক্লান্তি ভর করল। সেই ক্লান্তি নিয়ে এখনো হাঁটছেন। খুঁজছেন মিথ্যাকে।

দুনিয়ার মানুষের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন হজরত খিজির (আ.)। তিনি মানুষের ভয়াবহ রূপ আগাম দেখতে পেতেন। আল্লাহ তাঁকে সেই শক্তির একটি চশমা দিয়েছিলেন। খিজির (আ.)-এর চশমা দিয়ে হজরত মুসা (আ.) দুনিয়ার ভয়াবহতা দেখেছিলেন। এরপর মুসা (আ.) দুনিয়াকে আরও দেখতে, বুঝতে বের হলেন খিজির (আ.)-এর সঙ্গে। খিজির (আ.) প্রথমে মুসা (আ.)-কে নিতে সম্মত ছিলেন না। তিনি বললেন, আপনি পারবেন না আমার সঙ্গে চলতে। আমার অনেক কিছু ভালো লাগবে না আপনার। আপনি আমার কাজে বিরক্ত হবেন, আর আমাকে বিরক্ত করবেন। বিরক্ত করা মানুষকে পছন্দ করি না। অনেক আলোচনার পর দুজন পথচলা শুরু করলেন। তাঁরা চলতে থাকলেন সমুদ্রের কিনারা ধরে। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি নৌকা দেখলেন। তাঁরা নৌকায় চড়ে বসলেন। মাঝিরা গন্তব্য স্থানে নামিয়ে দিলেন দুজনকে। কোনো পয়সা নিলেন না। কারণ মাঝিরা খিজির (আ.)-কে চিনতেন। নৌকায় বসার পর খিজির (আ.) একটি তক্তার কাঠ ছিদ্র করে দিলেন। মুসা (আ.) তাঁকে বললেন, ওরা আমাদের বিনা পয়সায় নৌকায় তুলল। আর আপনি একটি তক্তা ছিদ্র করে নৌকার ক্ষতি করলেন। কাজটি ঠিক করেননি। গরিব মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলো। জবাবে খিজির (আ.) বললেন, আমি আগেই বলেছি, আমার সঙ্গে চলার ধৈর্য আপনার নেই। আমার কাজ পছন্দ না হলে দূর হোন। মুসা (আ.) চুপ করলেন। তাঁরা আবার হাঁটতে থাকলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর একদল বালককে তাঁরা খেলতে দেখলেন। খিজির (আ.) একটি বালককে ধরলেন। তারপর টান দিয়ে তার দেহ থেকে মাথা আলাদা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুসা বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ বালককে হত্যা করলেন? খিজির (আ.) আবারও রাগ করলেন। জবাব দিলেন না।

তাঁরা আবারও পথ চলতে শুরু করলেন। একটি অঞ্চলে গিয়ে তাঁরা স্থানীয় লোকদের কাছে খাদ্য ও আশ্রয় চাইলেন। কিন্তু সেখানকার লোকজন তা দিলেন না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তাঁরা খেয়াল করলেন একটি দেয়াল ধসে পড়ছে। তখন খিজির (আ.) নিজের হাতে দেয়ালটি ঠিক করে দিলেন। মুসা (আ.) বললেন, আপনি এটা কী করেছেন? ওরা আমাদের খাবার দিল না। আশ্রয় দিল না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আমরা কাতর। আপনি দেয়ালটি খাড়া করে দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ চাইতে পারতেন। জবাবে খিজির (আ.) বললেন, তোমার সঙ্গে আর চলব না। যাওয়ার আগে কাজগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমে বলছি নৌকার কথা। সেই নৌকার মালিকরা সবাই গরিব লোক। ওই এলাকার একজন শাসক আছেন যিনি জোর করে সব নৌকা নিজের কাছে নিয়ে নেন। কিন্তু কোনো নৌকায় ছিদ্র দেখলে তা নেন না। আমাদের নামিয়ে যাওয়ার পথে তারা অত্যাচারী শাসকের লোকজনের কবলে পড়বে। তারা আসবে নৌকা কেড়ে নিতে। আমি নৌকায় ছিদ্র করে দিলাম যাতে তারা না নেয়। বালকটিকে হত্যা করলাম এ কারণে তার বাবা-মা মোমিন নেকদার ভালো মানুষ। ছেলেটি বড় হয়ে অনেক খারাপ কাজ করবে। যাতে তার বাবা-মা ভয়াবহ কষ্ট পাবে। ছেলেটির জীবন নিয়ে নিলাম, আল্লাহ তার পরিবর্তে ভালো সন্তান উপহার দেবেন। সেই সন্তানটি অনেক ভালো হবে। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করবে। আর দেয়ালটি ঠিক করার কারণ- এর মালিক ছিল দুটি এতিম বাচ্চা। তাদের বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি সন্তানের জন্য দেয়ালের নিচে সম্পদ রেখে গেছেন। ভবিষ্যতে এই দেয়ালের নিচ থেকে এতিম বাচ্চারা বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ লাভ করবে। আর মনে রেখ, কোনো কিছু নিজের ইচ্ছায় করিনি। সব কাজ করেছি ওপরের তোমার প্রতিপালকের নির্দেশে। তিনি আমাকে সবকিছু দেখার সুযোগ দিয়েছেন। কাজগুলো করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সমাজ সংস্কৃতিতে সবকিছুই দুভাবে দেখা যায়। অনেক সময় বাস্তবতা না বুঝেই আমরা অনেক প্রশ্ন রাখি। সব প্রশ্নের জবাব মেলে না। আবার সবকিছু আমরা যেভাবে দেখি বাস্তব তা নাও হতে পারে। ছোট্ট একটা জীবনে নানামুখী রহস্যের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। যার কূলকিনারা নেই।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Leave a Comment