কক্সবাজারের–১ (চকরিয়া–পেকুয়া) আসনের সংসদ–সদস্য (এমপি) জাফর আলম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়দাখিল করা হলফনামায় অর্ধকোটি টাকার স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাত্র৪ বছরের ব্যবধানে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন।
শুধু এমপি জাফরই নন, প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে সম্পদ করার অভিযোগ উঠেছে স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী শাহেদা বেগম, ছেলেতানভীর আহমেদ তুহিন ও মেয়ে তানিয়া আফরিনের বিরুদ্ধে। এখন এসব সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক।
জেলা আওয়ামী লীগের ২১ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা সালাউদ্দিন আহমদ (সিআইপি) দাবি করেন–সন্ত্রাসীকার্যক্রমের মাধ্যমে রাজনীতিতে জাফর আলমের উত্থান। এমপি হয়েই পুরোনো পেশা চাঁদাবাজি, ও দখলবাজির মাধ্যমে জাফরএখন শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করে বলেন, দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েঘরছাড়া করা, তাদের জমি দখলে নেওয়া, আধিপত্য ধরে রাখতে নিজস্ব বাহিনী ‘জাফরলীগ’ গড়ে তোলা এবং চিহ্নিতকয়েকজন চোর–ডাকাতকে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন তিনি।
এমন কি সেনাবাহিনীর জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এ প্রভাবশালী এমপির বিরুদ্ধে। যদিও পরে তা উদ্ধার করা হয়।
এদিকে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে এমপি জাফরসহ পরিবারের ৪ সদস্যের সম্পদ অনুসন্ধানেমাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করে দুদকের রিপোর্ট তার পক্ষে যাবে বলে দাবি করেছেন এমপি জাফর আলম।
সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ–ক্ষমতা অপব্যবহার করে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিএবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এমপি ও তার পরিবারের সদস্যরা।
পাশাপাশি দেশে গাড়ি–বাড়ি ও বিপুল অর্থসম্পদের পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অন্তত ২০ কোটি টাকা পাচার এবংসেকেন্ড হোম গড়ে তোলার অভিযোগও উঠেছে এমপির ছেলে তুহিনের বিরুদ্ধে।
দুদক কক্সবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এমপিসহ অভিযুক্তদের নামে সাবরেজিস্ট্রার অফিস, চকরিয়া, কক্সবাজারে ২০১৬থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে ক্রয়, আমমোক্তার মাধ্যমে গ্রহণ, হেবাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২০০টি দলিল সম্পাদিত হয়েছে বলেঅভিযোগ উঠেছে। এসব সম্পদের মূল্য অন্তত ১০০ কোটি টাকা।
এছাড়াও এমপিসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত এবং সঞ্চয়পত্র ক্রয় করাআছে বলেও তথ্য পেয়েছে দুদক। যা এখনো তদন্ত চলমান বলে জানিয়েছেন তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া দুদক কর্মকর্তা রিয়াজউদ্দিন।
অবৈধ সম্পদ ও দখলবাজি : দুদক সূত্রে জানা গেছে, এমপি জাফর পেকুয়ায় জলাশয় ও পানি চলাচলের ড্রেন (সরকারি জায়গা) ভরাট করে তার মেয়ে তানিয়া আফরিন ও তার স্বামীর নামে নিউমার্কেট নির্মাণ করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৮ কোটি টাকা।
চকরিয়া পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ডে এসি ল্যান্ড অফিসের সামনে অন্যের জায়গা জবরদখল করে ছেলে তুহিন ও মেয়ে তানিয়া ওআমান উদ্দিনের নামে মার্কেট নির্মাণ চলমান রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য দেড় কোটি টাকা। চকরিয়া পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডগ্রিন ভ্যালির পাশে তানিয়া আফরিনের নামে ০২ একর জমি ক্রয় করে ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৩কোটি টাকার বেশি।
চকরিয়া পৌরসভার চিরিংগায় তানিয়া আফরিন ও তুহিনের নামে মাল্টিপ্লেক্স নামের একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। ওইমার্কেটের এরিস্টোডাইন নামক রেস্টুরেন্টও আছে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২১ কোটি টাকা। এছাড়া ছেলে তুহিনের নামে ৩টিবিলাসবহুল গাড়ি, ২০ কোটি ২৫ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মালেশিয়ায় পাচার এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম ক্রয় করারঅভিযোগ পাওয়া গেছে। জাফর ও তার ছেলেমেয়েদের চেয়ে প্রায় শতগুণ সম্পদ বেশি রয়েছে স্ত্রী শাহেদার নামে।
সবচেয়ে বেশি সম্পদ ক্রয় করা হয়েছে এমপি জাফরের স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে। সম্পদের পাশাপাশি অন্যদেরজমি দখল করে চকরিয়া থানা রাস্তার মাথায় সিস্টেম কমপ্লেক্স ও নিজের স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে মাল্টিপ্লেক্স ভবন ‘শাহেদাকমপ্লেক্স’ করার অভিযোগ উঠেছে। যার আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও চকরিয়া পৌর বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশের প্রাচীনতম জলাশয় দখল ও ভরাট করে একটি শিল্প গ্রুপের কাছে বিক্রিকরেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এমপি জাফর আলমের বিরুদ্ধে।
আরও জানা গেছে, গত বছর গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দকৃত রামপুর মৌজায় ৩০০ একর চিংড়ি প্রজেক্ট জামাল হোসেনচৌধুরীকে দিয়ে রাতের অন্ধকারে জবরদখল করে নিয়েছেন জাফর আলম। এ ছাড়াও এমপি জাফর আলমের প্রশ্রয় পাওয়াসন্ত্রাসীরা পেকুয়া ও চকরিয়াতে ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকটি চিংড়িঘের, হাজার একর বনভূমি দখল করে রেখেছেন।
বরইতলী–মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকার বিশালপাহাড় কেটে ফেলার অভিযোগ আছে এমপি জাফর আলমের বিরুদ্ধে। এমনকি সম্প্রতি সেনাবাহিনীর জায়গাও দখল করেছেনএমপি জাফর। যদিও পরে তা দখলমুক্ত করে সেনাবাহিনী। এ বিষয়ে উচ্চমহলে একটি প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।
এছাড়াও সংসদ–সদস্য জাফর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগপরিবারের জমি আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীদের একজন আওয়ামী লীগ নেতা মো. আলমগীর।
তিনি বলেন, পেকুয়া মৌজায় ২০২০ সালে এক মাসের ব্যবধানে ৬টি দলিলে নিঃস্বত্বদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে সংসদ–সদস্যনিজে ছাড়াও তার মেয়ে এবং নিকটাত্মীয়দের নামে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১ একর জমির মালিক বনেগেছেন। এ জায়গায় ডেভেলপারকে দিয়ে এখন নিউমার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ : স্থানীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ–এমপি জাফর ও তার বাহিনীদখলবাজি, চাঁদাবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
এছাড়াও তার মিথ্যা মামলা ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন চকরিয়া–পেকুয়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। অনেকে এখনঘরছাড়া বলে দাবি তাদের। মামলা–হামলার শিকার নেতাকর্মীদের একটা লিস্টও দিয়েছেন এসব নেতাকর্মী।
আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে রাজপথের সৈনিক হিসাবে পরিচিত পেকুয়ার যুবলীগ নেতা আজমীর ও নাম প্রকাশ না করারশর্তে আরও অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জানান, এমপি জাফরের পক্ষে দখলবাজি করতে রাজি না হওয়ার কারণেশত শত যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করেছেন এমপি জাফর। অনেকে এখনএলাকাছাড়া। আবার অনেকে প্রাণের ভয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ ছেড়ে এমপির নিজস্ব বাহিনী ‘জাফর লীগ’র সঙ্গেযোগদান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
যুবলীগ নেতা আজমীর বলেন, আমি এমপি জাফর আলমের পক্ষে অন্যের জমি দখল করতে রাজি হইনি বলে আমাকে ইয়াবাদিয়ে ফাঁসানো অথবা ক্রসফায়ারে দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও আমার ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখলেনেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমপি জাফর আলম।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সালাউদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ১৯৮৭–৮৮ সালে ডাকাতি করারসময় অস্ত্রসহ হাতেনাতে চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন জাফর। সে ছবি এখনো রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুঃসময়ের আওয়ামী লীগ করা শত শত দলীয় নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন জাফর। অনেকেরজমিজমা দখল করে নিয়েছেন।
ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ১০ হাজার একর চিংড়িঘের দখল করে সেখান থেকে মাসে ৫ কোটি টাকা করে আয় করেন জাফর।
আওয়ামী লীগকে গলাটিপে হত্যা করে নিজস্ব বাহিনী জাফরলীগ গড়ে তুলে চকরিয়া–পেকুয়ায় সন্ত্রাস ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকরেছেন। যাতে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক তলানিতে ঠেকেছে।
তিনি বলেন, গত স্থানীয় নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড় করে দিয়ে বেশ কয়েকজন আলোচিত চোর–ডাকাতকে জাফরজনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। এভাবে চকরিয়া–পেকুয়ার কয়েক লাখ মানুষকে জাফর জিম্মি করে রেখেছেন। এসব তথ্য জানিয়েদলীয় সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
এমপি জাফর যা বললেন : দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ সব অভিযোগ উল্লেখ করে জানতে চাইলে সংসদ–সদস্য জাফর আলমযুগান্তরকে বলেন, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় নেতা হানিফ ভাইয়ের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলষড়যন্ত্রকারীরা। পরে অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। এখন ষড়যন্ত্রকারীরা আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেদুদকে অভিযোগ দিয়েছে–যা ডাহা মিথ্যা। দুদককে এসব অভিযোগ তদন্ত করতে সহযোগিতা করেছি। আমি বিশ্বাস করিপ্রতিবেদন আমার পক্ষে যাবে। কোনো দলীয় নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দেননি বলে দাবি করেন তিনি।
ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জাফর আলম বলেন, সালাউদ্দিন বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যআমার নামে অপপ্রচার করছেন। তিনি বলেন, সালাউদ্দিন নারীর কাছেও এমপি নির্বাচনে বারবার হেরেছেন। এখন লোকে তারনাম দিয়েছে ‘নারীর কাছে লাত্তি’ খাওয়া সালাউদ্দিন। সেখানে আমি বিপুল ভোটে জয় পেয়েছি। একটা কর্মী সমাবেশ করারমতো তার লোক নেই।
এমপি জাফর আরও বলেন, সালাউদ্দিনের নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা না খেয়ে থেকেছে। অথচ আমিপ্রতিবছর ঈদে কর্মীদের জন্য এক কোটি টাকা খরচ করি। আজ নেতাকর্মীদের টাকার কোনো অভাব নেই।
স্বাধীনতাপরবর্তী নিজকে সবচেয়ে সফল এমপি দাবি করে জাফর আলম বলেন, আমি আমার আমলে শেখ হাসিনা নৌঘাঁটিনির্মাণ করেছি, রেললাইন করেছি, আমার সংসদীয় এলাকায় ৭১টি মাদ্রাসা ও স্কুলের ভবন নির্মাণ করেছি, ব্রিজ করেছি, এমনকোনো রাস্তাঘাট নেই যে আমি উন্নয়ন করিনি। এসব উন্নয়নের কারণে দল তাকে আগামীতেও মূল্যায়ন করবে বলে বিশ্বাসজাফর আলমের।
মাত্র চার বছরে শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অবৈধ কোনো সম্পদ অর্জন করেননি বলে দাবি করেনএমপি জাফর। তিনি বলেন, আমি এবং আমার পরিবারের সম্পদের বিষয়টি দুদক তদন্ত করছে।
সূত্র : যুগান্তর