লাভজনক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

জিনাত রেহানাঃ

‘প্লাস্টিক’ শব্দটি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। প্লাস্টিক বিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্লাস্টিক এমন একটি বস্তু যা সিন্থেটিক বা অর্ধ সিন্থেটিক জৈব যৌগ দ্বারা তৈরি। কম খরচ, সহজ উৎপাদন যোগ্যতা, বহুমুখীতা, পানির সাথে সংবেদনহীনতা ইত্যাদি কারনে ক্লিপ থেকে শুরু করে মহাকাশযানের বিভিন্ন ধরনের বহুমুখী পন্যে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্লাস্টিক প্রাকৃতিক ও গুানুগতিক বিভিন্ন উপকরন যেমন কাঠ, চামড়া, ধাতু, গ্লাস এবং সিরামিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। চায়ের কাপ থেকে শুরু করে ফার্নিচার, কম্পিউটার ফোন প্রভৃতি প্লাস্টিকের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এর ফলে বাড়তি চাহিদা মেটাতে একদিকে যেমন প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিমাণও বাড়ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত সমস্যা।


প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার প্রধান কারণ হলো এর বিয়োজন খুবই কষ্ট সাধ্য একটি ব্যাপার। কিছু প্লাস্টিক বর্জ্যরে বিয়োজিত হতে প্রায় হাজার বছরও লেগে যায়। যে জিনিসের বিয়োজিত হতে যত বেশি সময় লাগে, সে জিনিসটি পরিবেশের জন্য তত বড় হুমকির কারণ হয়ে দাড়ায়। কিন্তু এই প্লাস্টিক বর্জ্যকে আমরা সম্পদে পরিণত করতে পারি এবং পরিবেশকেও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পরি। তাই লাভজনক প্লস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমান বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় যে, ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে এর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব হয়েছে। বাকী অংশ বর্জ্য হিসেবেই পড়ে রয়েছে। এই বর্জ্যগুলো কোন না কোন ভাবে গিয়ে পেছায় সমুদ্রে। এতে করে প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণি হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ এই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জ্বালানি তেল, এলপিজি গ্যাস জেট ফুয়েল তৈরি করা সম্ভব। ড. মইন উদ্দিন সরকার বলেন, এক টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য থেকে ১ হাজার ৩০০ লিটার জ্বালানি তেল, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়বে ২০ টাকা। দেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের সকলের প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত।
প্লাস্টিক হলো পলিমার জাতীয় পদার্থ। এটি সাধারণত পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উদ্ভুত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যে অন্যান্য বর্জ্যের তুলনায় অধিক পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত থাকে। প্লাস্টিককে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে এর থেকে শক্তি পাওয়া যায়। এক পাউন্ড প্লাস্টিক থেকে যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যায়, তা প্রায় ইয়মিং কয়লা এবং জ্বালানি তেল থেকে উৎপাদিত শক্তির সমান। এর ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি লাভজনক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি।

এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ লাভজনক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্য একটি প্রক্রিয়া। প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি সরূপ হয়ে দাড়িয়েছে। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বরোপ করেছে। উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশেও দিন দিন প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহার মাত্র পাঁচ কেজির মতো, অন্যদিকে ভারতে আট কেজি, চীনে একত্রিশ কেজি, ব্রাজিলে বাইশ কেজি, আমেরিকায় একাত্তর কেজি প্রায়। প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়লেও, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে বর্তমানেঅনেক দেশেই লাভজনক উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা চলছে। যেমনঃ প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ তৈরি করা হচ্ছে। চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে প্লাস্টিক বর্জ্যরে লাভজনক ব্যবস্থাপনা চালু আছে। আমাদের সরকারের উচিত তাদের অনুসরণ করে প্লাস্টিক বর্জ্যরে লাভজনক ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন প্লান্ট স্থাপন করা। লাভজনক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কয়েকটি প্রক্রিয়া হলোঃ


১. পুর্ণব্যবহারঃ পুর্ণব্যবহার প্লাস্টিক বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করে। আমরা প্লাস্টিক পুর্ণব্যবহারকে গুরুত্ব না দিয়ে পুনঃপ্রক্রিয়াজকরণের উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করি। কিন্তু আমরা যদি প্লাস্টিক পুর্ণব্যবহার করি, এর ফলে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ফার্নিচার, ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমরা বর্জ্য হিসেবে না ফেলে পুর্ণব্যবহারের জন্য বিক্রি করে দিতে পারি। এর ফলে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারি এবং এটি দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি ভালো মাধ্যম হতে পারে। পুর্ণব্যবহারের ফলে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদন হ্রাস পাবে। এর ফলে কাঁচামাল আমদানি এবং অর্থনীতির উপর চাপ কমবে। অন্যদিকে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণও কমে যাবে এবং পরিবেশ ভালো থাকবে। তাই আমাদের সকলের প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুর্ণব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে যা শুধু পরিবেশের উপকার করবে না, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।


২. পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণঃ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য গুলো পুনরায় ব্যবহার উপযোগী পণ্যে পরিণত করা। এর ফলে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের খরচ কমে যায় এবং প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণও হ্রাস পায়। অনেক প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায় এবং সংগ্রহ করা অনেক উপকরণকে দ্বিতীয় বারের মতো ব্যবহার করা যায়। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা রয়েছে। এর ফলে এই পদ্ধতিটি পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬,৩৩,১২৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, এর ৫১ শতাংশ পুনঃব্যবহার করা হচ্ছে যার পরিমাণ ৩,২৩,০০০ টন। বাংলাদেশ সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করায় অনেক বর্জ্য কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে যার মধ্যে ৫০-৬০ টি সরাসরি প্লাস্টিক টুকরা বিদেশে রফতানি করছে। যা আমাদের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে।


৩. জ্বালানি উৎপাদনঃ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব। এর ফলে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব এবং পরিবেশ দূষনের হাত থেকে সমগ্র দেশ রক্ষা পাবে। এই তেল সব ধরনের যানবাহনে ও সেচপাম্পে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আবার এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এ জ্বালানি তেল বাজারে চলমান অন্যান্য জ¦ালানি থেকে অর্ধেক খরচে ব্যবহার করা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় ১ কেজি প্লাস্টিক থেকে ১.১২ লিটার তেল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এই তেল সম্পূর্ণ সালফার মুক্ত। এ প্রক্রিয়ায় ১৭% গ্যাস, ৪৩% পেট্রোল, ২৩% কেরোসিন, ১৪% ডিজেল এবং ৩% কার্বন রেসিডিউ তৈরি হয়। উৎপাদিত গ্যাস মেশিনে টেম্পারেচার হিট হয়। এই গ্যাসকেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। তাই এটি সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে ডিজেল, পেট্রোল ও তেল উৎপাদনের এই কৌশলটি বাস্তবায়িত হলে তা আমাদের দেশে শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে।


৪. বিদ্যুৎ উৎপাদনঃ প্লাস্টিকবর্জ্য থেকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। যেসকল প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব নয় সেগুলোকে আমরা আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে পারি। এই প্লাস্টিক বর্জ্য গুলো থেকে আমরা জ্বালানি তৈরি করতে পারি। এই জ্বালানি তৈরির সময় যে তাপ উৎপন্ন হয় তা দিয়ে টার বাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এই প্রকল্পটি যদি আমরা সারা দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোতে বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এমনকি আমরা বিদ্যুৎ ও গ্যাসরপ্তানি করতেও সমর্থ হবো। তবে এই প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানসম্মত ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে হতে হবে।
সর্বোপরি প্লাস্টিক বর্জ্যরে লাভজনক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা প্লাস্টিক বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করতে পারি। সরকার প্লাস্টিক বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করতে সরকারকে সাহায্য করা আমাদের সকলের দ্বায়িত্ব। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশেরপর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে লাভজনক প্লাস্টিকবর্জ্য ব্যবস্থাপনা। লাভজনক প্লাস্টিকবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে আমরা যেমন অর্থনৈতিকদিক থেকে লাভবান হবো অন্যদিকে আমাদের পরিবেশও বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষাপাবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
ই-মেইলঃ shemu.nib009@gmail.com

Leave a Comment