জন্ম থেকে আ. লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন যারা

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ। আগামীকাল শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) দলটির ২২তম জাতীয় সম্মেলন।প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের। দেশের যত অর্জন, আন্দোলন, সংগ্রাম আর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে আছে দলটির নাম। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়েরসংগ্রামে যুগে যুগে বহু নেতা তৈরি হয়েছেন অসাম্প্রদায়িক এই দলে। তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা এসব নেতাকে ধীরে ধীরেদল পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করে সফল হয়েছে আওয়ামী লীগও।

অতীতের সম্মেলনগুলোতে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যনির্বাহী কমিটি পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছেন শত শত নেতা। তবে, এখন পর্যন্তসভাপতি হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ নয় বার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ছাড়ামওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুইবার এবং এইচ এম কামারুজ্জামান আবদুল মালেক উকিল একবার করে সভাপতিনির্বাচিত হয়েছেন। আর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন একবার নির্বাচিত হয়েছেন দলের আহ্বায়ক। ছাড়াও মহিউদ্দিন আহমেদদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন জন। সবচেয়ে বেশি চারবার করে হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমান জিল্লুর রহমান। এছাড়া তাজউদ্দিন আহমেদ তিনবার, আবদুর রাজ্জাক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দা সাজেদাচৌধুরী ওবায়দুল কাদের দুইবার করে, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, আবদুল জলিল একবার করে সাধারণসম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪৯ সালের ২৩ ২৪ জুন পুরনো ঢাকার রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তানআওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে ১৯৫৫ সালের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে দলের নামথেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয় আওয়ামী লীগ।

শুরু থেকেই মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটিতে। প্রভাবশালী বা অভিজাত হিসেবে পরিচিতরাসেভাবে আসেননি এই দলে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যন্ত দলটির ২১টি নিয়মিত জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমেদলটিতে এসেছে নতুন মুখ।

পাকিস্তান আমল

আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রথম জাতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিল প্রায় ৩০০ জন। উদ্বোধনী ভাষণ দেন মাওলানাআবদুল হামিদ খান ভাসানী। পরে প্রতিনিধিদের সমর্থনে ৪০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিনির্বাচিত হন মাওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন  শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩ সালের থেকে জুলাই মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনেও সভাপতি নির্বাচিত হনমাওলানা ভাসানী। আর দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদটি পান শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলে তৃতীয় সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় দলের। দলের নামথেকে একটি ধর্মের নাম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন মাওলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৭ সালে চতুর্থ সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন মাওলানা ভাসানী। ১৩ জুন আরমানিটোলার নিউপিচকার হাউজে এবং পরদিন গুলিস্তান সিমেনা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিল আটশজন। প্রতিনিধিদের ভোটেমাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

দলের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। মার্চ থেকে মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কাউন্সিলর ডেলিগেট ছিল প্রায় হাজার। এতে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন মাওলানা তর্কবাগীশ শেখমুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য ঐতিহাসিক একটি সম্মেলন। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফাদলীয় ফোরামে পাস হয়। ১৮ থেকে ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখমুজিবুর রহমান। আর প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমেদ। এতে কাউন্সিলর ডেলিগেটের সংখ্যাছিল হাজার ৪৪৩ জন।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক তখন অনুষ্ঠিত হয় দলের সপ্তমজাতীয় সম্মেলন। ১৯ থেকে ২০ অক্টোবর হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দনজরুল ইসলাম। প্রায় হাজার চারশত ৫৩ জন কাউন্সিলর ডেলিগেট এতে অংশ নেন। সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানসভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন।

১৯৭০ সালের উত্তাল সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের অষ্টম সম্মেলন। সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফা ১১ দফাগ্রহণ করে রাজনৈতিক সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নেয় আওয়ামী লীগ। ৭০ সালের থেকে জুন হোটেলইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কাউন্সিলর ছিল হাজার ১৩৮ জন। কাউন্সিলরদের ভোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

স্বাধীন বাংলাদেশে সম্মেলন

১৯৭২ সালের থেকে এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম এবং সব মিলিয়ে নবম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিতহয় সার্কিট হাউজ রোডে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নেরজন্য শপথ নিয়ে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি জিল্লুর রহমান সাধারণসম্পাদক নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগের ১০ম জাতীয় সম্মেলন ১১২ সার্কিট হাউজ রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালের ১৮জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যরা দলের পদে থাকতেপারবেন না। ফলে, বঙ্গবন্ধু দলীয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের সভাপতি হন এইচ এম কামারুজ্জামান এবংসাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান।

এরপরই ঘটে ১৯৭৫এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হন সপরিবারে। সামরিক সরকার ক্ষমতাদখল করে। ১৯৭৫এর নভেম্বর কারাগারের ভেতরে নিহত হন আওয়ামী লীগের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দনজরুল ইসলাম, এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুঃসময় এসে হাজির হয়।

এমন একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালের থেকে এপ্রিল হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতেকাউন্সিলর ছিলেন প্রায় হাজার ৪০০ জন এবং ডেলিগেটও সমসংখ্যক ছিল। এতে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দাজোহরা তাজউদ্দীন।

এর পরের বছর ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১২তম জাতীয় সম্মেলন। থেকে মার্চহোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে প্রায় হাজার ৫০০ কাউন্সিলর এবং সমসংখ্যক ডেলিগেট নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনটি। এতেসভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল মালেক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক।

১৯৮১ সালের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দলীয় ঐক্য ধরেরাখার জন্য সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আনা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে।৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সম্মেলনেকাউন্সিলর ডেলিগেট ছিল হাজার ৮৮৪ জন। সভায় শেখ হাসিনা সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিতহন। পরে ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক দলত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। দলের নেতৃত্বপাওয়ার পর দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

১৯৮৭ সালের থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৪তম জাতীয় সম্মেলন।এতে কাউন্সিলর ডেলিগেট ছিল প্রায় হাজার। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকনির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৯২ সালের ১৯ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ১৫তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর মেয়াদী করা হয়। এতে কাউন্সিলর ছিল প্রায় হাজার৫০০ ডেলিগেটও ছিল সম সংখ্যক। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ১৬তম জাতীয় সম্মেলন আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রায় ২১ বছর পর দলটিক্ষমতায় আসার পর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সম্মেলন। থেকে মে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে কাউন্সিলর ছিল হাজার ৫১৬ এবং ডেলিগেটও ছিল সমসংখ্যক। এতে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন শেখ হাসিনা জিল্লুররহমান।

২০০২ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধীদলে তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় দলের ১৭তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনেশেখ হাসিনা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল জলিল।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় দলটির১৮তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

২০১২ সালে ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পুননির্বাচিত হন শেখ হাসিনা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

২০১৬ সালের ২২ ২৩ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়।সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ ২১ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন সোহারাওয়ার্দী উদ্যানেঅনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক পুণর্নির্বাচিত হন।

Leave a Comment