প্রযুক্তির বিবর্তনে করণীয় কি?

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির সাথে মার্কেটিং এর যে যুগল-যাত্রা শুরু হয়েছে তা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে ভাবা দুষ্কর। বছর খানেক আগে যে পণ্য গুলো ছাড়া দৈনন্দিন জীবন ভাবা সম্ভবপর ছিল না বছর খানেক পরে সে পণ্য তো দূরে তাদের খুজে পাওয়া দায় হয়ে পড়ে। এর কারণ প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে মার্কেটিং এর ধরণ মেজাজ মর্জি পাল্টে যাওয়া। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এক সময়কার মার্কেট লিড দেয়া সাবান, প্রসাধনী কিংবা প্রযুক্তি ব্র্যান্ডগুলো কি কারণে আজ প্রায় বিলুপ্ত? আবার প্রযুক্তি দুনিয়া কাপানো মোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নোকিয়া আজ শীর্ষ ১০ কোম্পানি হিসেবে কোনো তালিকায় নেই? আবার মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস গুলোর দিকে তাকালে স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আসে এর মাধ্যমে নিশ্চই দেশে কর্মসংস্থান এর সৃষ্টি হচ্ছে, মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিকাশ, রকেট এর মাধ্যমে মোবাইল রিচার্জ করে হয়ত আপনি বেশ আশাবাদী এই ভেবে যে এর মাধ্যমে ফ্লেক্সিলোড এজেন্টরা আরো একটি ব্যবসার ক্ষেত্র খুজে পেলো। কিন্তু মুদ্রার এপিঠ দেখলে আপনাকে এর অপর পিঠ’ও দেখতে হবে, বিকাশ রকেটে আরো একটি বহুল ব্যবহৃত অপশন আছে। হ্যা, মোবাইল রিচার্জ এর কথাই বলছি, মানুষ এখন স্মার্ট হয়েছে, টাকা রিচার্জের জন্য কেহ আর এজেন্টের কাছে যান না ঘরে বসেই মোবাইল রিচার্জ সেরে নেন। ফ্লেক্সিলোড এর দোকান এখন এই কাজগুলো না জানা মানুষগুলোয় চলছে, আর বাকিরা কেবল বিকাশ রকেটে এ ক্যাশ আউট/ইন এর মতো কাজগুলোই করতে যান।…. ধীরে ধীরে এই দোকান গুলি এখন মোবাইল ফোনের পার্টস বিক্রয়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আজকের দশকে দাড়িয়ে আপনি হয়ত ভাবতেও পারছেন না, ২০৪০ এ পৃথিবীটা কতটা বদলে যাবে! প্রযুক্তির প্রভাবে আজকের অধিকাংশ চাকরিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই কাজগুলো করা হবে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে।

বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটর্স সিমিত আকারে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাত করেছে, এখন প্রক্রিয়া চলছে এর উৎপাদনমূল্য কিভাবে হ্রাস করে সকল স্তরের ক্রেতার আস্থা অর্জন করা যায়। ২০২০ সালের মধ্যেই এই একটা আবিষ্কার বদলে দিতে পারে গোটা দুনিয়ার চাল-চিত্র। এর ফলে সামনের ২০ বছরে বর্তমানের অধিকাংশ গাড়িই রাস্তা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বেঁচে থাকা এই গাড়িগুলো হয় ইলেক্ট্রিকে চলবে অথবা হাইব্রিড গাড়ি হবে। এর ফলে তেল এর ব্যবহার ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেলের মূল্য কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে এবং অর্থনীতির বিকল্প কোনো পথ না বের করতে পারলে এক পর্যায়ে বেশ ক’টি দেশ দেউলিয়াও হয়ে যেতে পারে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেখিয়ে দিয়েছেন টেসলা মোটর্স এর প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক নিজেই !

২০০৮ সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন অতি শীঘ্রই সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি বাজারে আনতে চলেছে তার কোম্পানি। তারপর দিনই এর প্রভাবে আকষ্মিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস পায় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল মজুদকারীদের মাথায় হাত পড়ে! পাশাপাশি তেল ব্যবসায় করে বিলিয়নিয়ার হওয়া ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়তে বাধ্য হয়। একটি ছোট্ট পরিবর্তন বড় পর্যায়ে কতটা প্রভাব ফেলে এটা যেনো তারই একটি উদাহরণ। গাড়ির এই বিপ্লবে শুধু ইলেক্ট্রিসিটি একাই দাপট দেখাবে তা নয়, এর সাথে চালকবিহীন গাড়িও মাঠে নেমে যাবে আগামী দশ বছরের মধ্যে। “চালকবিহীন গাড়ি” ও “বৈদ্যুতিক গাড়ি” এই দুটি বৈশিষ্ট্য যে পৃথিবীতে কতটা পরিবর্তন আনতে চলেছে তা আজকের দশকে দাঁড়িয়ে বোঝা মুশকিল। চালকবিহীন গাড়ি সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত হলে ড্রাইভারের খরচ হ্রাস ও প্রয়োজনমতো গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সুবিধা পেতে প্রায় ৯০% ক্রেতাই এই বিশেষ বৈশিষ্টের গাড়ি কিনবে এর ফলে ড্রাইভিং পেশার সাথে জড়িত এক বিশাল জনশক্তি বেকার হয়ে পড়বে। শুধু যে ড্রাইভারদের বেকারত্বই হবে তা কিন্তু নয়, ড্রাইভিং শেখার প্রতিষ্ঠানগুলোও মুনাফা করতে না পেরে বিলুপ্ত হবে। আবার এই সুবিধার পাশাপাশি যদি ঐ একই গাড়ি বৈদ্যুতিক সুবিধায়ও চলে তাহলে তো কথাই নেই, আজ মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলো তেল ব্যবসা করে মোট অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে তারা হয়ে পড়বে দেউলিয়া যার ফলস্রুতিতে সৌদি আরবের মতো তেল নির্ভর দেশগুলো চাপে পড়ে হজ্জ ও বিভিন্ন ধর্মীয় খরচ বৃদ্ধি করে দিবে।

এবার কৃষির কথায় আসি; চীনে সম্প্রতি কৃষক সংকট দেখা দিয়েছে যার অন্যতম কারণ গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলোর শহরমুখীতা। তাই চীনের কৃষি মার্কেটে এক বিপ্লবের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলস্বরূপ চীনা প্রযুক্তিবিদেরা এক বিশেষ ড্রোন তৈরী করেছে যার মাধ্যমে আবাদি জমির এক পাশে দাড়িয়েই আপনি রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের মাধ্যমে ঐ ড্রোনের সাহায্যে পুরো আবাদী জমির ফসলের হালচাল বুঝতে পারবেন, শুধু এটুকু দিয়েই ক্ষান্ত হবে না ঐ ড্রোন, তৎক্ষনাৎ বিশেষ বাক্সে মজুদ রাখা লিকুইড সার ছিটিয়ে কৃষকের অধিকাংশ কাজই করে দিবে সে, অতিরিক্ত কোনো মজুরী ছাড়াই! চীনে এই প্রযুক্তি এতই জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হচ্ছে যে অতি শীঘ্রই অন্যান্য কৃষিপ্রধান দেশগুলোয় এই সেবা পৌছে যাবে। মজুরি ও যাবতীয় মেইনটেইনেন্স খরচ কমবে বলে কৃষিকাজের হাল ধরবে পাকা ব্যবসায়ীরা। এভাবেই বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যেতে পারে কৃষকের সংখ্যা, এই কৃষি প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাবে ড্রোন চালানোয় দক্ষ কর্মীরা। বিল গেটস, ল্যারি পেইজ প্রমুখ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংএ এমন এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন যে প্রতিদিনই এখন ডেভেলপাররা লাখ লাখ সফটওয়্যার ইন্টারনেট এ ছাড়ছে। এর মধ্যে আছে বেশ কিছু শিক্ষনীয় সফটওয়্যার SPSS, Loan Calculator, FreshBooks ইত্যাদি অন্যতম।

ফিন্যান্স, হিসাবরক্ষন কিংবা পরিসংখ্যান এর যাবতীয় অসৃজনশীল কাজগুলো এক ক্লিকেই সম্পন্ন করতে এখন হাতের নাগালেই মেলে হাজার হাজার সফটওয়্যার। ব্যবহারকারী চাইলে যেকোনো সময় তা ইনস্টল করে শুধু যথাযথ তথ্য দিয়ে মুহুর্তেই নির্ভুলভাবে সঠিক ফলাফল পেতে পারে। এই সফটওয়্যার গুলোর প্রভাব শিক্ষাখাতে পড়তে বাধ্য। সফটওয়্যার এর নির্ভুল ফলাফল, সহজলভ্যতা ও এককালীন ব্যয় হওয়ায় একসময় হিসাববিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান এর মেধাবী ছাত্রদেরও নিজেদের ক্ষেত্রে কাজের সুযোগের অভাবে অন্য সেক্টরে কাজ করতে হবে, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিশেষ ক’টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের আসন সীমিত করে আনতে বাধ্য হবে।

শুরুতে যে নোকিয়ার উদাহরণ দিয়েছিলাম, এখন সে টপিকে আসি। নোকিয়ার মার্কেট ধ্বসে পড়ার অন্যতম কারণ এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম এর প্রতিযোগিতায় নোকিয়ার নিজস্ব সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের সাথে পেরে না ওঠা। এন্ড্রয়েড যে কাজটি ভালোভাবে করেছে তা হলো ক্রেতাদের মাঝে নতুন চাহিদা তৈরি করা ও ক্রেতার আগ্রহের দিকটি বিবেচনায় আনা। চারদিকে এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের এত চাহিদা থাকার পরেও তারা নিজেদের সেই পুরাতন অপারেটিং সিস্টেম নিয়েই পরে ছিল। একসময় নিজেদের ভুল বুঝতে পারে কোম্পানিটি তবে আবারো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নোকিয়া এন্ড্রয়েডে না গিয়ে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম গ্রহণ করায় আবারো মুখ থুবড়ে পড়ে এক সময়কার টেক জায়ান্ট কোম্পানি। সময়ের চাহিদা না বুঝে নিজেদের গোড়ামি তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দিকে। আপনি যদি বাজারে কোনো প্রসাধনী সামগ্রী সবুজ প্যাকেটে মুড়ে বিক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেন তবে তা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এর একটি সাইকোলজিক্যাল কারণ আছে, মানুষ স্বভাবতই কোনো পণ্যের ভেতরের জিনিষটার সাথে বাইরের মোড়কের সামঞ্জস্য চান। আপনি যদি দাত ঝকঝকে সাদা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হলুদ মোড়কে টুথপেষ্ট বিক্রয় করতে যান তবে ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা সময় ছিলো যখন মানুষ সবুজ রঙের মোড়ককে “হালাল পণ্য” হিসেবে দেখতো, তবে এখন ক্রেতাদের মানসিকতা পরিবর্তিত হয়েছে। যতই প্রাকৃতিক গুনাবলী সমৃদ্ধ সাবানের কথাই বলুন না কেনো, বিজ্ঞাপনে যদি ফুলের সুবাসের কথা উল্লেখ না করেন ও গোলাপি রঙের মোড়ক ব্যবহার না করতে পারেন তবে এক পর্যায়ে আপনার প্রসাধনীর ব্যবসা বাধ্যতামূলক গুটিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যুগের পরিবর্তন ও প্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে অসৃজনশীল চাকরীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তৈরি হবে নতুন চাকরীর ক্ষেত্র, তবে সেটার সুযোগ কেবলমাত্র তারাই নিতে পারবেন যারা আধুনিক প্রযুক্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবেন। তো যে কথাটি বলছিলাম, সময়ের সাথে নিজেকে ও নিজের ব্যবসাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে একটা সময় যুগই আপনাকে তার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিবে।

লেখক :- মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ,শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment