শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ঘোচাবে কে!

সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া এস.এস. এসি পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সারা দেশে প্রায় নয়জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নয়টি প্রাণ অকালেই ঝড়ে যাওয়ার একটাই কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের সুন্দর ভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা না দিয়ে ঠেলে দিচ্ছি মৃত্যুর দিকে। কেরানি বানানোর এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের প্রতিনিয়ত ভাবাতে বাধ্য করছে। ছোটবেলার ভাব সম্প্রসারণে পড়তাম শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আজ সেই মেরুদন্ডই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।বলা হয়, যেখানে গুণের কদর নেই, সেখানে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে তেল ঘি দুটোর মূল্যে পার্থক্য নেই।

একই দামে বিক্রি হয় লবণ এবং চিনি। আমাদের দেশে শিক্ষদের জীবন যাপন করতে হয় খুবই সাধরণ ভাবে বলা চলে এক প্রকার মানবেতর জীবন যাপন।তাই গুরু সমূহ বিপদের আশঙ্কায় রাজ্য ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেও সহজলভ্য ও সস্তা খাবারের লোভে শিষ্য সেখানে রয়ে যায়। অনেক দিন পর কাকতালীয়ভাবে গুরু সংকটাপন্ন শিষ্যের প্রাণ রক্ষা করেন। জাতি-দেশ-সমাজ সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে পারে শিক্ষকের দ্বারা। শিক্ষা নামের অদৃশ্য মেরুদণ্ড শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করতে পারেন একমাত্র শিক্ষক। যতই সুদৃশ্য ভবন কিংবা ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হোক, তা সর্বাংশে সার্থক হবে না শ্রেণীকক্ষে একজন সুশিক্ষক না দেয়া পর্যন্ত। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে পরীক্ষানির্ভর। বর্তমান পদ্ধতির সুবাদে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া গেলেও জ্ঞানের সীমা থাকে প্রান্তিকতম পর্যায়ে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ে ‘ও এবং এ লেভেল’ শিক্ষার্থী সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও এ কথারই প্রতিচিত্র পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরীক্ষায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই সর্বাধিক নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু পঠিত বিষয়ে সামান্য ঘুরিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি ভালোভাবে জানা থাকার পরেও ছাত্রছাত্রীরা উত্তর দিতে ব্যর্থ হতো।

কারণ পরীক্ষা পদ্ধতি সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেও জ্ঞানের গভীরতা তৈরিতে অসমর্থ। ফলস্বরূপ ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করলেও পাঠ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকে সীমিত। তাদের পড়াশোনা, চর্চা, অনুশীলন মার্ক স্কিমনির্ভর, যাতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে প্রশ্নের কোন অংশের উত্তর কেমন হলে কত নম্বর পাবে একজন পরীক্ষার্থী। মার্ক স্কিম চর্চা করে আশানুরূপ ফল পাওয়া সহজ। বিদ্যালয়ের বাইরে বাকি সময়টুকু মার্ক স্কিম চর্চা করতেই ব্যয় হয়। পাঠ্যবইয়ের বা সিলেবাসের বাইরে তাদের ইচ্ছে থাকলেও অন্য কিছু পড়ার সুযোগ একেবারেই নেই বলা চলে।মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ বছর একাধিক বার বেতন বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে শিক্ষকরা কখনও আন্দোলন করেছেন সমসাময়িক ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না।

শিক্ষা ব্যবস্থা তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে কিছু ব্যতিক্রম ত্র“টি-বিচ্যুতি নিয়েই। সর্বস্তরের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি সরকার তার নিজস্ব সুযোগমতো বিবেচনা করে। তাই নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কোনোরূপ অসন্তোষ থাকলেও আন্দোলনের হুমকি নেই, ছিলও না।সামাজিক মর্যাদা, কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় যাদের আমরা জাতি গঠনের কারিগর বলে প্রশংসা করি, তাদের আর্থিক প্রণোদনা, পেশাগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, পেশাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনমাফিক নয়। শিক্ষক সমাজ অন্যান্য পেশাজীবীর মতো ইচ্ছা করলেই দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামতে পারেন না। যখন-তখন আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেন না।শিক্ষক সমাজে রয়েছে বিভাজন, যেমন সরকারি শিক্ষক, বেসরকারি শিক্ষক, এমপিওভুক্ত শিক্ষক, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রভৃতি। এই বিভাজনের মূলে রয়েছে বেতনের বৈষম্য ও প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাব। বিভিন্ন সরকারি বিভাগের সঙ্গেও শিক্ষকদের সাধারণ বৈষম্য বিদ্যমান। বেতনের বাইরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা- যেমন পরিবহন, আবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত।

তারপরেও তারা শিক্ষা ব্যবস্থা চলমান রাখেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নির্বিঘ্ন ও নিয়মিত রাখেন।জাতীয় ও সামজিক দায়িত্ব ছাড়াও শিক্ষাবিষয়ক পরিকল্পনার সঙ্গে শিক্ষকদের জড়িত রাখা হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সর্বোত্তম পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি কিংবা পুস্তক রচনা করেন। কিন্তু প্রায়ই তাদের পরিশ্রম শতভাগ কাজে লাগে না। বিশেষ করে পাঠ্যসূচি এবং পুস্তকের ক্ষেত্রে দেখা যায় মুদ্রিত হওয়ার পরে কোনো অদৃশ্য উপায়ে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অজ্ঞাতে, সবকিছুর খোলনলচে বদলে দেয়া হয়েছে। এমন তুঘলকি ঘটনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এনছে অস্থিরতা।অপরিকল্পিতভাবে স্কুলভবন বিন্যস্ত করা হয়। নতুন ভবন নির্মাণের সময় ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার জন্য খোলা জায়গার ব্যবস্থা সংকুচিত হয়। পুরনো ভবন এসব ক্ষেত্রে ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করলে জায়গার সংকট অনেকাংশেই কম হতে পারে। তাছাড়া সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকে যদি বহুতল ভবনের পরিকল্পনা নেয়া হয়, তাহলেও স্থান সংকট কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, তদারক এবং মনিটরিং নিয়মিত করা গেলে শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলেজ পর্যায়ে মনিটরিং সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করা যায়।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা এবং আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি বিবেচনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য রকমে পিছিয়ে আছে।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা একজন মানুষের আজীবনের ভিত্তি তৈরির কেন্দ্র। সেখানকার শিক্ষকদের যোগ্যতা মানসম্মত হলে প্রমিত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। অন্যান্য সরকারি চাকরির তুলনায় বেতনের বৈষম্য থাকায় মেধাবীদের এই ক্ষেত্রে আগ্রহ কম। যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের অভাবে ভবিষ্যৎ নাগরিকের সুশিক্ষায় ত্রুটি থেকেই যাবে।

শিক্ষার এই ত্রুটি আমৃত্যু জাতি, সমাজ ও ব্যক্তিকে পীড়িত করবে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও ইউজিসির মাধ্যমে বাজেট বরাদ্দসহ সরকারি সংশ্লিষ্টতা এখানে বিদ্যমান। এ কারণে সাধারণ মানুষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই বলে থাকে। পরিবেশগত কারণে ভার্সিটি শিক্ষক এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত একজন সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে সৃষ্টি হয় সুযোগ-সুবিধা, বেতন, ভাতা, পরিবহন, আবাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুস্তর ব্যবধান। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিবেদিতভাবেই শিক্ষা দিয়ে আসছেন। বৈষম্য নিয়ে কখনোই উচ্চকিত নন। পড়াশোনা শেষ করে ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়নের সূচনা করতে পারেন সেসব ছাত্রছাত্রী।

বাস্তবে তারা সবাই জানেন কারা তাদের শিক্ষক, কী অবস্থায়, কেমন পরিবেশে, কীভাবে তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে তারা ওই পরিবেশের কথা সম্ভবত কাজের চাপে মনে রাখতে পারেন না। নানা রকম কারণে ইচ্ছা থাকলেও হয়তো অবস্থা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারেন না।বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। জনসংখ্যা বেশি হলেও ভৌগোলিক কারণে পরস্পরের হদিস ভালোভাবেই রাখা যায়। কে কোথায়, কীভাবে, কোন অবস্থায়, কেমন আছে তার খোঁজ রাখা কঠিন কিছু নয়। পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার বহুলাংশে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।

দরকার সহানুভূতি এবং আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করার মানসিকতা। সবরকম বৈষম্য, বিভেদ, সংকট অতিক্রম করা তখন আর দুঃসাধ্য থাকে না। শিক্ষকদের পরিচালনা, পরামর্শ, তদারকির ভার সঠিকভাবে শিক্ষকদের ওপর দিলে যাবতীয় বিষয় সহজেই এবং সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে। মাঠ পর্যায়ে বাস্তব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে এক শ্রেণীর দায়িত্ববানরা সর্ববিষয়ে পারদর্শী সেজে শিক্ষাক্ষেত্রে অনর্থক জটিলতা পাকাচ্ছেন। তাদের পক্ষে সাময়িকভাবে পুচ্ছধারী কাক সেজে, পণ্ডিতম্মন্য ভেবে নিজের আত্মতুষ্টি পাওয়া সম্ভব। সম্ভব আরেক শ্রেণীর মানুষের হাততালি ও বাহবা পাওয়া। কিন্তু তাতে জাতির লোকসানের সম্ভাবনাই বৃদ্ধি পায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহিদ হাসান,পোর্টসিটি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

Leave a Comment