ঐতিহাসিক ‘বদর’ দিবস আজ

আবু নোমান রুমি।।

আজ থেকে ৮১৬বছর আগে এই দিনে সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ, বদরের যুদ্ধ। পবিত্র আল-কুরআনে এ যুদ্ধকে অভিহিত করা হয়েছে ইয়াওমূল ফুরক্বান না ফয়সালাকারী দিন হিসেবে। এ যুদ্ধে মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফের শক্তিকে পরাজিত করেন যার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ ঘটে। এ কারণে বদরের যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়।

বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরাইশরা রাসুল (স)-কে মদীনা থেকে বের করে দেয়ার নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। অবশ্য কুরাইশ কাফেরদের বাণিজ্য কাফেলাকে বাধা দেয়ার লক্ষ্যে ও তাদের সম্পদ আটকের জন্যই একদল মুসলিম মুজাহিদ বিশ্বনবী (স) এর নেতৃত্বে মদীনা থেকে বেরিয়ে আসেন। কাফেররা মক্কায় মুসলমানদের অনেক সম্পদ আটক করে রেখেছিল। তাই এ ধরনের হামলার অধিকার মুসলমানদের ছিল। তবে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ হবে বলে মুসলমানদের কেউই ভাবেননি এবং সে জন্য প্রস্তুতিও ছিল না। কিন্তু কুরাইশ কাফেরদের শীর্ষস্থানীয় নেতা আবু সুফিয়ান তার বাণিজ্য কাফিলার ওপর মুসলমানদের হামলার প্রস্তুতির খবর জানতে পেরে সেই খবর মক্কার কাফিরদের জানালে অনেক কাফের নেতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ফলে তারা একটি সুসংগঠিত যুদ্ধের আয়োজন করে এবং মুসলমানরাও মহানবীর (সা.) নেতৃত্বে কাফেরদের মোকাবেলা করতে বাধ্য হন।

এ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা মাত্র ৩১৩ জন হওয়া সত্ত্বেও তারা মক্কার সুসজ্জিত প্রায় এক হাজার কাফেরের ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন। মহান আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য থাকাতেই তা সম্ভব হয়েছে। এ যুদ্ধে কাফের বাহিনীর ৭০ জন মুজাহিদদের হাতে নিহত এবং তাদের ৭০ জন মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। অন্যদিকে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শাহাদত বরণ করেন। মুসলমানদের পক্ষে এই যুদ্ধের প্রধান বীর ছিলেন আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)। তিনি একাই ৩৬ জন কাফিরকে হত্যা করেছিলেন যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল নেতৃস্থানীয় কাফের সর্দার ও তৎকালীন আরব বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান যোদ্ধা ।

বদর যুদ্ধ ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী অথচ একটি অসম যুদ্ধ। ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফয়সালাকারী যুদ্ধ। কেননা একটি সুসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ অধিক ও প্রশিক্ষিত সেনাদলের সাথে অপ্রস্তুত, অসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ কম এবং বাস্তভিটা হারা মুহাজির ও নওমুসলিম আনসারদের এ যুদ্ধে জয় লাভ ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এ কারণেই এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফয়সালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে ।

বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। বদর যুদ্ধ ছিল মুসলিম ও মুশরিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুখোমুখি সশস্ত্র যুদ্ধ, যে যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয়। এছাড়া এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। বদরের যুদ্ধের বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ।

বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবূ জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কূরয বিন জাবের ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুটে নেবার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই। আল্লাহর সাহায্যই সবচেয়ে বড় সাহায্য – সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন সাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হ’ল বড় বিষয়। স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতা মন্ডলী পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলের বালু নিক্ষেপের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১৭) অতঃপর ফেরেশতাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।

যুদ্ধের উদ্দেশ্য হতে হবে জান্নাত লাভ। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তা ক্ষেত্রের যুদ্ধ হোক বা সশস্ত্র মুকাবিলা হোক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে জান্নাত লাভ। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাসিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্র শক্তি ব্যয় হবে না। বদরের যুদ্ধ আমাদের আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতেও শেখায়। বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন,

وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)।

Leave a Comment