আজ বৃহস্পতিবার। ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি। এখন সময় সকাল ১০:১৭

৭ নভেম্বর ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়

৭ নভেম্বর ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়
নিউজ টি শেয়ার করুন..

ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক নভেম্বর আজ। ১৯৭৫ সালের আজকের দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্মম অধ্যায়ের সূচনা হয়।সেদিন সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে সে দিন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যাকরা হয়। এদিনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিকে ওলোটপালট করে দেয়। যার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি জাতি।

সময়ের হাত ধরে নভেম্বর আজ একটি গোষ্ঠির কাছে জাতীয় বিপ্লব সংহতি দিবস। মুক্তিযুদ্ধের অনুসারীদের কাছেমুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর শুরু হয়জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

১৯৭৫ সালের পনের আগস্টের কালরাতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একই ঘাতকচক্র নভেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মাত্র চারদিন পরই নভেম্বর থেকে শুরু হয়মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকাণ্ড। আর এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিল জাতীয় বিপ্লব সংহতি দিবস দাবিদার অংশটি।

১৯৭৫ সালের এদিনে তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে প্রথমে হত্যা করা হয় তিন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে। এরা হলেনখালেদমোশাররফ বীর উত্তম, কে এন হুদা বীরউত্তম এবং এটিএম হায়দার বীর বিক্রম। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরেঅবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুজন কোম্পানি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল। ব্যাপারে সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস তার এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এদিন উচ্ছৃংখল জওয়ানরা একজন মহিলাডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও সময় হত্যা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

গবেষক গোলাম মুরশিদ তারমুক্তিযুদ্ধ তারপরগ্রন্থে লিখেছেন কর্নেল শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেয়েও থেকেগিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু যখন বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন তিনি সঙ্গীদেরনিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। এতে তার পা ভেঙ্গে যায় এবং পরে ধরা পড়েন। তাকে ভর্তি করা হয় সামরিক হাসপাতালে।উল্লেখ, নভেম্বর ভোর রাতে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটিদল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার অন্যতম ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিলো এই দলের নেতৃত্বে।তারা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন কর্নেল রশিদের দুই নম্বর আর্টিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে। গোলাম মুরশিদআরো বলেন, মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের অনুমতি ব্যতিরেকেবেতারে ভাষণ দিতে চলে যান।

সেদিন জিয়াউর রহমান সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দাবি করেন। পরে অবশ্য পদবীবদলিয়ে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গণভোট (হ্যাঁভোট নাভোট), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিভিন্ন তথ্যে পাওয়াযায় তার আমলে ২০টির বেশি অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে। এসব অভ্যুত্থানে অসংখ্য সামরিক সদস্য নিহত হন। যাদেরবেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা। বিশেষ করে৭৭ সালের অক্টোবর বিমানবাহিনীর অভ্যুত্থানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারেঅথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয়। এক পর্যায়ে বিমানবাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতেপারতেন মাত্র তিনজন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই অভ্যুত্থানের কারণে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়। সর্বশেষ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একপূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর মঞ্জুরসহ ১১ জন সামরিক কর্মকর্তা যাদের মুক্তিযুদ্ধেগৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো তাদের প্রহসনের (!) বিচারে ফাঁসি দিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের যে জায়গায়নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দেশকে আবারও সে জায়গায় নিয়ে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিপাহী বিপ্লবের নামে কার্যত নবেম্বর থেকেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যা প্রক্রিয়া।

আসলে নভেম্বরের কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে সরকারে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছিল। অথচ কর্নেলতাহেরকে ২১ জুলাই ১৯৭৬ ফাঁসি দেওয়া হয় জিয়ার চক্রান্তেই। আর নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ পরবর্তী সেনা বিদ্রোহগুলোতেওভূমিকা রেখেছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিবিদ বিশিষ্ট গবেষকগণ নভেম্বরকেমুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকাণ্ডহিসেবেচিহ্নিত করেছেন।

জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকে বন্ধ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধানসামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবংনিজে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্তইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরেসামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন তিনি।

সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিলো। পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করাযেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেননি। তিনি সামরিক জান্তা বরং খুনিদের সুবিধা দিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর মঞ্জুরসহ ১১ জন সামরিককর্মকর্তা যাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো তাদের ফাঁসি দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এভাবে ষোলকলা পূর্ণ হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার ইতিহাস দিয়ে। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে যে বীর বাঙালি বীরত্বে সঙ্গে লড়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর ছদ্মবেশিপাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে সেই বীর সন্তানদের প্রাণ দিতে হয়। নবেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর অফিসারহত্যাকান্ড তারই একটি অধ্যায়।

লেখক : রেজা এনায়েত ,গবেষক।


নিউজ টি শেয়ার করুন..

সর্বশেষ খবর

আরো খবর