জাদুঘরে ঘুরতে কে না ভালোবাসে? এই পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিখ্যাত কত শত জাদুঘর। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ফ্রান্সের লুভর, মাদ্রিদের প্রাভো মিউজিয়ামের এমন বহু নাম বলে শেষ করা যাবে না। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক দেখতে করতে আসে বিখ্যাত এসব জাদুঘর। তাদের মধ্যে কিছু জাদুঘর রয়েছে বেশ বৈচিত্র্যময়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মজাদার সব বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে আশ্চর্য সব জাদুঘর। তেমনি দুটি জাদুঘরের একটি হচ্ছে লন্ডনের হাতপাখার জাদুঘর আর অন্যটি প্যারিসের ড্রেনেজ মিউজিয়াম। মানুষের অদ্ভুত সব খেয়ালে তৈরি এই জাদুঘর দুটি একবার ঘুরে আসা যাক।
হাতপাখার জাদুঘর
হাতপাখার এই অসাধারণ জাদুঘরটি দেখতে পাওয়া যাবে লন্ডনের গ্রিনউইচে। গ্রিনউইচ পার্ক ও গ্রিনউইচ থিয়েটারের খুব কাছেই অবস্থিত লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে সতের শতকের হেরিটেজ বাড়িগুলোর একটিতে ১৯৯১ সালে এই জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। খুব ছোট পরিসরে জাদুঘরটি তৈরি হলেও এখানে প্রচুর হাতপাখার সংগ্রহ রয়েছে। জাদুঘরটির একেবারে নিচতলায় স্থায়ীভাবে একটি সংগ্রহশালা ও বিক্রির আয়োজন রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়তলায় অস্থায়ীভাবে দর্শকদের জন্য হাতপাখা প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রাচীনকালের বিভিন্ন সময় থেকে শুরু করে আধুনিককাল পর্যন্ত হাতপাখার যে বিবর্তন ঘটেছে তা অত্যন্ত নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানেÑযা এক কথায় অসাধারণ।
আঠারো শতকের গোড়া থেকে ইউরোপে হাতপাখা তৈরি শুরু হয়। তবুও চীন থেকে আসা পাখার আবেদন তখনো ছিল তুঙ্গে। লন্ডনের গ্রিনউইচের এই মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে যে পাখাগুলো স্থান পেয়েছে তার ঐতিহাসিক মূল্যও প্রচুর। হেলেন অব ট্রয়, আইভরি পার্ল ফন্টেজ, ট্রাইফোল্ড প্রভৃতি ৩,৫০০-এর কাছাকাছি দুষ্প্রাপ্য সব হাতপাখা রয়েছে এই জাদুঘরের সংগ্রহশালায়।
প্যারিসের ড্রেনেজ মিউজিয়াম
আপনি জানেন কি প্যারিস শহরের তলায় রয়েছে আরো একটি প্যারিস? সেখানেই মাইলের পর মাইল রয়েছে রাস্তা, রাস্তার মোড়, গলিপথ। শুধু যা নেই, তা হলো মানুষ। প্যারিসের ঐতিহাসিক নিকাশি ব্যবস্থার এই বর্ণনাই করা হয়েছে ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’-এ।
প্যারিসের শহরগুলোতে মধ্যযুগ পর্যন্ত পানি সরবরাহ করা হতো সেইন নদী থেকে। সময়টা ছিল ১১২০ থেকে ১১২৩ সালের মধ্যেই ফ্রান্সের রাজা ফিলিপের রাজত্বকাল। ওই সময় মানুষের ব্যবহৃত পানি আবার গড়িয়ে গিয়ে পড়ত নদীতে। এ কারণে স্বভাবতই লোকজনের মাঝে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ ছিল অনেক বেশি।
রাজা ফিলিপ তখন বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরবর্তীতে তার নির্দেশেই রাস্তার পাশেই তৈরি হলো নর্দমা। তেরো শতক থেকেই প্যারিসে নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই ব্যবস্থা অনুসারে পরিকল্পনা করা হয় মানুষের ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ বা পানি অথবা যেকোনো কিছুই হোক তা যাতে নদীতে গিয়ে না পড়ে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সময় প্যারিসে ছিল আরো সুন্দর পদ্ধতি। শহরের তলায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ঢাকা দেওয়া অবস্থায় ছিল পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা।
১৮৫০ সালে ইউজিন বেলগ্রান্দ নামে এক ফরাসী প্রকৌশলী আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন যেন মাটির তলা দিয়েই পাইপের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি এবং নোংরা পানি উভয়ই চলাচল করিয়ে নেওয়া সম্ভব। এসব ময়লা, নোংরা পানি শহরের অদূরে এমন জায়গায় ফেলা হতো যাতে লোকারণ্যের কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়।
১৮৫০ সালে তৈরি ইউজিনের নিকাশি নকশা আজ বেড়ে ২,১০,০০০ কিলোমিটার বিস্তৃত টানেলে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি বলতে গেলে পুরো প্যারিসের আনাচে-কানাচে বিস্তৃত। এই টানেলগুলো মাটির ওপরের রাস্তাঘাটগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রেখেই নকশা করা হয়েছে। এমনকি টানেলগুলো দিয়ে গেলে প্যারিস শহরের যেকোনো বাড়ি শুধু নম্বর দেখেই চিহ্নিত করা যাবে। আর বর্তমান যুগে তা আরো আধুনিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এসব টানেলের মধ্য দিয়েই ইলেকট্রিক লাইন, টেলিযোগাযোগের কেবল নেটওয়ার্ক এগুলোও সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্যারিস শহরকে এত কিছুর মাঝেও সুন্দর দেখাতে দিনরাত কাজ করে চলেছেন প্রায় ৮০০-এর অধিক নিকাশিকর্মী। শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো অংশেই কমতি নেই যেন। মাটির ওপরের প্যারিসের মতোই মাটির তলার প্যারিস শহর সমানভাবেই পরিপাটি। অনেকেই উৎসুক হতে পারেন মাটির তলার এই প্যারিস শহর ঘুরে দেখতে।
অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার হলো, তলার প্যারিস ঘুরে দেখার জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা। শুরুর দিকে উৎসুক দর্শকদের খনিতে ব্যবহারের মতো গাড়ির সাহায্যে ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা থাকলেও পরবর্তীতে গন্ডোয়ার মতো নৌকায় চাপিয়ে ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। তারপর সে ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যায়।
প্যারিস নিকাশি জাদুঘর অর্থাৎ, খব গঁংবব ফবং ঊমড়ঁঃং ফব চধৎরং-এ যাওয়ার জন্য সেইন নদীর ধার ঘেঁষে পার্কটির পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। সপ্তাহে বৃহস্পতি ও শুক্রবার ছাড়া বাকি পাঁচ দিনই বেলা ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্য নির্ধারণ হয়েছে চার ইউরো। টিকিট কেটেই যেখানে যাবেন, চোখের সামনেই দেখবেন বিশাল ম্যানহোলের মতো সুড়ঙ্গপথের সিঁড়ি। বহু শতাব্দীর প্রাচীন প্যারিসের ধীরে ধীরে গড়ে ওঠার ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে এই দুই কিলোমিটারের লম্বা টানেল মিউজিয়ামে। উন্নত প্রযুক্তির অবদান যে কেমন হতে পারে তা ফিল্ম শো, ফটো গ্যালারি, এমনকি শতাব্দী প্রাচীন যন্ত্রপাতি এবং কর্মরত নিকাশি কর্মীদের মূর্তি না দেখলে বিশ্বাস হতেই চাইবে না। মিউজিয়ামটির একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে বিশেষ আকর্ষণমূলক গিফট শপ। আপনার কোনো কাছের বন্ধুর যদি এই মিউজিয়ামটি দেখার সুযোগ না হয়ে থাকে, তবে গিফট শপ থেকে তার জন্য অন্তত মিউজিয়ামের ছোঁয়াটুকু হলেও স্মৃতি হিসেবেই নিয়ে আসতে ভুলবেন না কিন্তু।