আজ মঙ্গলবার। ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। ১৩ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি। এখন সময় বিকাল ৩:১৬

বাকশাল পদ্ধতি

বাকশাল পদ্ধতি
নিউজ টি শেয়ার করুন..

১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাকশালের মূল স্তম্ভ ছিলো ৪টি। দুর্নীতি দমন, উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য।

১৯৭৫ এর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেয়া ৪টি ভাষণে/বক্তব্যে (২৫শে জানুয়ারি সংসদে, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনায়, ২৯শে জুন বাকশাল কমিটির আলোচনায়, ২১শে জুলাই বাকশাল ব্যবস্থায় নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের সাথে মিটিংয়ে) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাকশাল সম্পর্কে একদমই খোলামেলা করে সহজবোধ্য ভাষায় কথা বলেছেন।

বাকশাল ব্যবস্থায় সকল ধরনের প্রশাসনিক কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ করার কথা ছিলো।

মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিনত করার পরিকল্পনা রাখা হয়।

আইন ও বিচার বিভাগের স্থবিরতা দূর করা, যাতে প্রান্তিক জনগন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার পায়।

গ্রাম সমবায় ব্যবস্থা চালু করা। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ছিলো ৫ বছরে কমপক্ষে ৫ হাজারেরও বেশি ‘গ্রাম সমবায়’ চালু করা। জমির মালিক থাকবে জনগনই। তাতে সেচ, সার, বীজসহ সকলরকম সহযোগিতা করবে সরকার। উৎপাদিত ফসল ৩ ভাগে ভাগ হবে। কৃষকেরা পাবেন ১ভাগ, সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত বাকিরা ১ ভাগ এবং সরকার ১ ভাগ। এখানে উল্লেখ্য যে, বাকশাল ব্যবস্থায় কমিউনিজমের মতন ভূমির মালিকানা সরকারের হাতে নিয়ে নেয়ার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা। কৃষকেরা সমবায় পদ্ধতিতে ফসল ফলাবে, সরকার সর্বপ্রকার সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে।

গ্রাম পর্যন্ত প্রশাসনিক কাঠামোর সকল স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং আমলারা থাকবেন। তারা সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় কাজ পরিচালনা করবেন। আমলাতন্ত্রের উপর একক নির্ভরশীলতা থাকবেনা।

নির্বাচনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়ে অংশগ্রহণ করবেন। জনগনের সরাসরি ভোটে একজন জয়ী হবেন। জেনারেল ওসমানী আওয়ামীলীগের এমপি ছিলেন। বাকশালের বিরোধিতা করার কারণে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা হয়। সিলেটে তার আসনে বাকশাল পদ্ধতিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩ জন প্রার্থীর মধ্যে যিনি জনগণের সরাসরি ভোটে জয়লাভ করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, নাম আশরাফ উদ্দিন।

৪টি বাদে সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো; কথাটি অর্ধেক সত্য। যাচাই-বাছাইয়ের পর ১২৪টি পত্রিকার ডিক্লারেশন দেয়া হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৭ই জুন পত্রিকাগুলোতে এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

তখনকার পত্রিকাগুলো আমাদেরকে বাসন্তী দেখিয়েছিলো, শেখ কামালকে ডাকাত বানিয়েছিলো। মাওলানা সাহেবের ‘হক কথা’ নামক পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলে নকশাল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘রাজশাহী অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন’ শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

বাকশাল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ছিলোনা। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করা দল আওয়ামীলীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ বাকশালে ছিলো।

বাকশালের বাইরে ছিলো জাসদ, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও সর্বহারার মতন মাওবাদী দল এবং মাওলানা ভাসানী। জাসদ ৭৪ সালে গণবাহিনী গঠন করে দেশে ব্যাপক নৈরাজ্য চালায়। জাসদের সন্ত্রাসী বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় হামলা চালায়, পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ করে, এমনকি খুন করে ৪ জন এমপিকে (কুষ্টিয়ায় ঈদের জামাত শেষে গুলি করে খুন করা হয় এমপি গোলাম কিবরিয়াকে)। এসবের পর বাকশালে জাসদের থাকা অসম্ভব হয়ে যায়।

৭২ এর ১০ জানুয়ারি থেকে ৭৪ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্বদেশ পুনর্গঠনের কাজে পূর্ণ মনোযোগী ছিলেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা মেরুকরণের মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে কূটনৈতিক লবি সচল রাখতে হয়েছিলো জাতির পিতা ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে। দেশের তৎকালীন আমলাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলো বৃটিশ শোষকশ্রেণীর মানসিকতা যা বঙ্গবন্ধুর মতন জনতার নেতার চিন্তার সাথে চরম সাংঘর্ষিক ছিলো।

দলীয় নেতা কর্মীদের অনেকে জাতির পিতার চিন্তা এবং পরিকল্পনার সাথে তাল মেলাতে পারছিলেন না। কেউ ভাবতে থাকেন, স্বাধীনতা অর্জনই সব; তাকে রক্ষা করার প্রয়োজন হবেনা। অনেকে জড়িয়ে পড়েন নির্লজ্জ্ব দুর্নীতিতে।

এতকিছুর পরেও বঙ্গবন্ধু সেই সময়ে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ১২৬টি রাষ্ট্রের এবং জাতিসংঘসহ ২৭টি সংস্থার স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানামুখী দুর্নীতি, নৈরাজ্য আর অস্থিরতার ফলে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ৭৪ সালের শেষে দেশে জারি করা হয় জরুরী অবস্থা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এই ধারা চলমান থাকলে স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনোই অর্জিত হবেনা।

তারপর আসলো যুগান্তকারী শাসন ব্যবস্থা বাকশাল। বাকশালকে সফল কিংবা বিফল বলা যাবেনা, কারণ তা চালু হয়নি কখনোই। ৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগও সেপথে আর হাঁটেনি। তবে বাংলাদেশ সবসময়ই বাকশালের ছায়ায় আবদ্ধ থাকবে। কারণ এর চেয়ে বেশি কার্যকর কোন ব্যবস্থা কেউ প্রবর্তন করতে পারেনি। গ্রাম্য আদালত, গণমুখী প্রশাসন, গণমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, রাজনীতিবিদদের প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; সবই বাকশালের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের পুনর্গঠন খুবই দুরূহ কাজ। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। তারও ৪ বছর পর ১৯২১ সালে লেনিন নতুন অর্থনৈতিক মতবাদের ধারণা দেন। মাঝের চার বছর সময় গিয়েছে দেশ পুনর্গঠনে, অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা রক্ষায় ও গৃহযুদ্ধ সামলানোতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই, ১৯৭২ সালে বাকশাল করা সম্ভব হয়নি।

বাকশাল হলো ২য় বিপ্লব। ১ম বিপ্লব ছিলো স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জন, ১ম বিপ্লব ছিলো লাল-সবুজের জমিনে জয় বাংলা বলার সার্বভৌমত্ব অর্জন করা।

আওয়ামীলীগের অনেক নেতা-কর্মী ই বাকশাল নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন; বাকশালকে স্বৈরাচারের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব আর আকাশের মতন উদারতার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সম্পর্কে এমন ধারণা স্বাধীন বাংলার বুকে ক্ষত করে দেয়।

লেখা : তানভীর হোসেন সিফা


নিউজ টি শেয়ার করুন..

সর্বশেষ খবর

আরো খবর