আজ শনিবার। ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি। এখন সময় রাত ১২:৩০

নারীদের জন্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ এক ভাষার সৃষ্টি, পুরুষদের কাছে আজো অজানা

নারীদের জন্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ এক ভাষার সৃষ্টি, পুরুষদের কাছে আজো অজানা
নিউজ টি শেয়ার করুন..

একটি জাতির সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয় ভাষা। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ভাব বিনিময়ের জন্য মানুষ ভাষার ব্যবহার করে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলেছে। কোনো কোনো জাতির ছিল নিজস্ব সৃষ্ট ভাষা। যা তাদের করেছে সমৃদ্ধ। তবে কোনো ভাষা তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র নারীর জন্য এটা জানতেন কি? খানিকটা অবাক করা বিষয় হলেও ঘটনা সত্যি। 

চীনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হুনান প্রদেশ এই ভাষার জন্ম। ভাষা এবং লিপিকে ঘিরে নানান আশ্চর্য ঘটনা বিভিন্ন সময়ে আমরা শুনতে পাই। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কিভাবে একটি ভাষার জন্ম হল সেই সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা। ইতিহাস থেকে এরকমও জানা গিয়েছে বেশকিছু লিপি নানান বিশেষ প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল। সেগুলোকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল এরকম উদাহরণ‌ও আছে। কিন্তু শুধুমাত্র নারীদের জন্য নুশু ভাষা ও লিপির উদ্ভব হয়েছিল। এই ভাষা বা লিপিতে মূলত নারীরাই কথা বলত।

শতকের পর শতক ধরে তার চর্চা চলে। মূলত পুরুষদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে নারীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই এই ভাষা এবং লিপির উদ্ভব হয়। তাই বলা যেতে পারে এই ভাষার লিপি আসলে এক ধরনের বিদ্রোহ ছিল।

নুশু, চীনের দক্ষিণ-পূর্বের হুনান প্রদেশের জ্যাংইয়াং গ্রাম এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই গোপন ভাষার উদ্ভব প্রথম ঘটেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে দশম শতকের শেষভাগে এই ভাষার প্রথম উদ্ভব হয়। নবম শতকের দিকে যখন সং রাজবংশ (৯৬০-১২৭৯) চীনের শাসনে ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কিছু লিপি উদ্ধার করা হলেও ধারণা করা হয় প্রাচীনযুগ থেকেই গোপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই ভাষা।

চিং রাজবংশের (১৬৪৪-১৯১১) এবং পরবর্তী সময়েই নুশু ভাষা এর সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করেছিল। তবে এই ভাষার বহুল ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকে হুনান প্রদেশের জ্যাংইয়াংয়ের মতো গ্রামগুলোতে। ওখানকার হান, ইয়াও এবং মিয়াও গোষ্ঠীর নারীরা একে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিল। তৎকালীন চীন দেশে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হত। তাদের যেমন পড়াশোনা করার অধিকার ছিল না তেমন কোনো কিছুতেই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারত না মেয়েরা। এই পরিস্থিতিতে নারীরা যাতে নিজেদের মত করে একটি জগত রচনা করে নিতে সক্ষম হয় সেই জন্যেই এই নুশু ভাষা ও লিপি প্রস্তুত হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই ভাষার উদ্দেশ্যের মতোই লিপিগুলোও ছিল ধারালো, দেখলে মনে হবে যেন ছুরির ফলা!

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় পথ চলার পরও এই ভাষার পরিচয় পায়নি কোন‌ো পুরুষ। একান্তভাবেই মেয়েদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যে সমস্ত মেয়েরা নুশু ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠত তারা প্রত্যেকেই নিরক্ষর ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে একজন নিরক্ষর মানুষ কি করে নিজের মাতৃভাষার বাইরে গিয়ে অপর একটি লিপি শিখে উঠতে সক্ষম হবে?

আসলে সেই সময় চীনের মেয়েরা বাইরে বের হতে পারত না। তাই কাজকর্ম সেরে বিশ্রাম নেয়ার সময় তারা ছবি আঁকার মত করে নুশু লিপি লেখা অভ্যাস করত। দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে একসময় সে চীনা ভাষা অর্থাৎ মান্দারিনে নিরক্ষর হ‌ওয়া সত্ত্বেও নুশু লিপিতে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠত! এইভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গোপন ভাষা চীনের মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

একবিংশ শতকের আগে পর্যন্ত মাত্র একজন পুরুষ নুশু ভাষা ও লিপিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন! ঝৌ শুয়াইয়ি নিজের এক চাচির কাছ থেকে এই গোপন ভাষার সমস্ত কিছু শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাও সে তুং চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিলে সবকিছু তোলপাড় হয়ে যায়।

তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতারা নুশু ভাষার যাবতীয় নিদর্শনকে সামন্ততান্ত্রিক চীনের চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর ফলে ছিল ভয়াবহ। নুশু লিপিতে লেখা যাবতীয় বইপত্র ধ্বংস করে দেয় কমিউনিস্ট চিন। এমনকি এই ভাষা নিয়ে গবেষণা চালানোর কারণে ঝৌ শুয়াইয়ি’কে ২১ বছর শ্রম শিবিরে কাটাতে হয়। ২০০৩ সালে এই ব্যক্তি মারা যান। তার আগে নুশু ভাষায় একমাত্র অভিধানটি তিনি রচনা করে গিয়েছেন।

  1.  জ্যাংইয়াং গ্রামের কাছে অবস্থিত পুওয়েইয়ে নামে একটি ছোট্ট গ্রামে নুশু ভাষার জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই এলাকার আশেপাশের আঠারোটি গ্রামে দীর্ঘদিন যাবৎ নুশু ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। যদিও বর্তমানে এই ভাষায় আলাদা করে কেউ কথা বলে না। তবে চীন সরকার সম্প্রতি এই ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে হুনান প্রদেশের মেয়েদের মধ্যে নুশু ভাষা শেখার জন্য ভালো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।

নিউজ টি শেয়ার করুন..

সর্বশেষ খবর

আরো খবর