নিজস্ব প্রতিবেদক :
একটি ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। রোগটি মারাত্মক ছোঁয়াচে। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে।
নেত্রকোনার ফলে স্থানীয় কৃষকরা গবাদিপশু নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নেত্রকোনা ছাড়াও দেশের ভিবিন্ন জায়গা রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে।
স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘লাম্পি’ একটি ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। রোগটি মারাত্মক ছোঁয়াচে। এ কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সময়মতো ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এটি সেরে উঠবে। আগে কখনও এমন প্রাদুর্ভাব দেখা না দেওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা প্রথমে রোগটি চিনতে পারেনি। পরে আক্রান্ত গরু চিকিৎসার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা রোগটি শনাক্ত করেন।
খরমুহরি গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন, রামপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম এবং সামছু মিয়া তাদের আক্রান্ত গরুর লক্ষণ বর্ণনা করে জানান, প্রথমে গরু জ্বরে আক্রান্ত হয়। জ্বরের সঙ্গে মুখ এবং নাক দিয়ে লালা আসে। শরীরের চামড়ায় গুটি বা পি- আকৃতির ক্ষত ধারণ করে এবং লোম উঠতে থাকে। ক্ষতগুলো ক্রমশ মুখ এবং পাসহ শরীরের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।এ সময় আক্রান্ত গরু মুখে কোনো খাবার নিতে চায় না। এক পর্যায়ে গরুগুলো মারাত্মক দুর্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
ছিলিমপুর গ্রামের বিপুল মিয়া জানান, তার খামারের অন্তত ১০টি গরুর এমন লক্ষণ দেখা দিয়েছে। কেন্দুয়ার পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায়ও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
কান্দিউড়া গ্রামের আক্কাছ মিয়া ও নোয়াদিয়া গ্রামের জুলহাস মিয়া জানান, তাদের নিজের গরুসহ গ্রাম দু’টির আরও অনেকের গরু বিরল এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমদিকে অনেকে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে গরুকে খাইয়েছেন। এতে অনেকের দুই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচও হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পরবর্তী সময়ে তারা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করেন।
কেন্দুয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. খুরশিদ দেলোয়ার লাম্পি রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা স্বীকার করে বলেন, এটি মূলত ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। এক প্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এ রোগ দেখা দেয়; যা এক গরু থেকে আরেক গরুতে দ্রুত ছড়িয়ে পরে।
রোগের লক্ষণ : এল এস ডি আক্রান্ত গরু শুরু থেকে যে লক্ষণ প্রকাশ করে যা আক্রান্তের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে দেখা যায় :
১. জ্বর : আক্রান্ত গরু প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং খাবার রুচি কমে যায়।
২. লালাক্ষরণ : জ্বরের সাথে সাথে মুখ দিয়ে এবং নাক দিয়ে লালা বের হয়।পা ফুলে যায়। সামনের দু “পায়ের মাঝ স্থান পানি জমে যায়।
৩. শরীরের বিভিন্ন জায়গা চামড়া পিন্ড আকৃতি ধারণ করে, লোম উঠে যায় এবং ক্ষত সৃষ্ট হয়। ধারাবাহিকভাবে এই ক্ষত শরীরের অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়ে।
৪. ক্ষত মুখের মধ্যে , পায়ে এবং অন্যান্য জায়গা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৫. ক্ষত স্থান থেকে রক্তপাত হতে পারে। শরীরে কোথায় ফুলে যায় যা ফেটে টুকরা মাংশের মত বের হয়ে ক্ষত হয় , পুঁজ কষানি বের হয়।
৬. পাকস্থলী অথবা মুখের ভিতরে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে গরু পানি পানে অনীহা প্রকাশ করে এবং খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।
কিভাবে ছড়ায় : লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগটি অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যম গুলো হচ্ছে :
১. মশা ও মাছি : এই রোগের ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসাবে মশা মাছিকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কিট পতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২. লালা : আক্রান্ত গরুর লালা খাবারের মাধ্যমে অথবা খামারে কাজ করা মানুষের কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে।
৩. দুধ : যেহেতু আক্রান্ত গভীর দুধে এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে তাই আক্রান্ত গভীর দুধ খেয়ে বাছুর দুধ খেয়ে আক্রান্ত হতে পারে।
৪. সিরিঞ্জ : আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকে এই ভাইরাস বাহিত হতে পারে।
৫. রক্ষণাবেক্ষণকারী : খামারে কাজ করা মানুষের পোশাকের মাধ্যমে আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৬. আক্রান্ত গরুর সিমেন : ভাইরাস আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন এই রোগের অন্যতম বাহন কারণ আক্রান্ত গরুর সিমেনেও এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকে।
৭. শুধু মাত্র গরু মহিষ আক্রান্ত হয়, মানুষ হয় না।
প্রতিকার : যেকোন রোগের চিকিতসার চেয়ে প্রতিকার সব সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
১. আক্রান্ত গরুকে নিয়মিত এল এস ডি ভ্যাকসিন দেয়া। আমাদের দেশে ইতিপূর্বে রোগটির প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে তাই এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়।
২. খামারের ভিতরের এবং আসে পাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যেন মশা মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৩. আক্রান্ত খামারে যাতায়ত বন্ধ করা এবং আক্রান্ত খামার থেকে আনা কোন সামগ্রী ব্যবহার না করা।
৪. আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা মশা মাছি কামড়াতে না পারে। কারণ আক্রান্ত গরুকে কামড়ানো মশা মাছি সুষ্ঠ গরুকে কামড়ালে এই রোগের সংকরণ হতে পারে।
৫. আক্রান্ত গাভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া।
৬. আক্রান্ত গরুর পরিচর্যা শেষে একই পোশাকে সুষ্ঠ গরুর মধ্যে প্রবেশ না করা।
৭. আক্রান্ত গরুর খাবার বা ব্যবহার্য কোনো জিনিস সুষ্ঠ গরুর কাছে না আনা।
৮. ক্ষত স্থান টিনচার আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার রাখা।
চিকিৎসা : এল এস ডি আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিতসার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই কৃষকরা আক্রান্ত গরু নিয়ে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে আসছেন। আক্রান্ত গরুর চিকিৎসার জন্য প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোরও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।