আজ বৃহস্পতিবার। ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ। ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি। এখন সময় রাত ১১:৪৪

আত্মহত্যার কারণ কি শুধুই অভিমান?

আত্মহত্যার কারণ কি শুধুই অভিমান?
নিউজ টি শেয়ার করুন..

গত রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার হাজারীবাগে একটি নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আত্মহত্যা করেন। তার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পরিবারের কেউ কোন কারণ দেখাতে পারেনি। কিন্তু জানা যায়  চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বাসায়ফেরার পরে ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি।

চলতি বছর  ১৭ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বাজার এলাকায় তৃতীয় শেনীর এক শিশু আত্মহত্যা করে। পরিবার সুত্রে জানা যায় মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহহত্যা করে শিশুটি। মায়ের কাছে মোবাইল কিনে চাইলে তা নাকিনে দেয়া হলে নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে শিশুটি।

২রা ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্র নায়ক রিয়াজের শ্বশুর। রাজধানীর ধানমন্ডি নম্বর রোডের নিজ ফ্লাটে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন এই ব্যবসায়ী।

শুধুমাত্র উপরের এই তিনটি  ঘটনাই নয়, প্রতিদিনের সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে এক থেকে একাধিক আত্মহত্যার খবর। সামাজিক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য জরিপে দেখা যায় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তার মধ্যে দেখা যায় স্কুলের ১৪১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার সবথেকে বেশি।জরিপে  ১৬০ জন স্কুল শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলে উল্ল্যেখ পাওয়াযায়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজার ৭৪৯ জন। ২০১৭ ২০১৮ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২৫৬ ১১ হাজার। ২০১৯২০ সময়কালে করোনার সময়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন, যাদের মধ্যে ২০৩৫ বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি। তবে চলতি বছর১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যা হার বেশি দেখা গেছে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছে সমাজ বিজ্ঞানিরা। পারিবারিক কলহ,প্রেম ঘটিত জটিলতা,বেকারত্ব,নি:সঙ্গতা,মানসিক চাপ,তীব্র বিষন্নতা থেকে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।  সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে দেশে তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয় মূলত শিক্ষাজীবন শেষ করার পর চাকরি না পাওয়া, জীবনের প্রতি হতাশাগ্রস্থ,নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ষনের শিকার হওয়ায় সামাজিক লজ্জা,বিয়ের পর যৌতুকের দাবি।

অনেকেই মনে করেন ডিপ্রেশনের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ডিপ্রেশন মূলত সেই রোগ যা চাওয়া পাওয়ার পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয়। কোন কিছু নিজের না থাকা, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা হীনম্মন্যতার সৃষ্টির করে, যা পরে আত্মহত্যায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়া বড়দের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতায় দেখা গেছে  অনেকেই নিঃসঙ্গতা থেকে এই পথ বেছে নিচ্ছেন।এছাড়া দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, সামাজিক চাপ, ঋণগ্রস্থ আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি করছে।

অনেক গবেষনায় উঠে এসেছে আত্মহত্যার সাথে করোনার যোগসূত্র। সাম্প্রতিক ভারতে মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে করোনাকালে সব মিলিয়ে ৪৩ শতাংশ ভারতীয় কোন না কোনভাবে মানসিক সমস্যার মুখোমুখী হয়েছেন।লকডাউনের সময় এই পরিমাণ ছিল আরও বেশি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা খেয়াল করলে দেখা যায় করোনা পর্বর্তী মানসিক চাপ কমলেও জটিল মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনাকাল এবং করোনা পর্বর্তী সময়ে আবার আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। করোনাকালে অনেকে হারিয়েছেন চাকরি, অনেকে হারিয়েছেন প্রিয়জন, অনেক শিক্ষার্থী আর্থীক সমস্যার মধ্যদিয়ে গেছেন ফলে এগুলো মানসিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন প্রায় দশ লাখ মানুষ। তাদের মতে সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যা তার মধ্যে ত্রয়োদশতম প্রধাণ কারণ। আর আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৩৫ বছর বয়সের নিচের মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যাই সব থেকে বেশি।

তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়াচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক মিডিয়ার অতি ব্যবহার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাইন্টারনেট ভিত্তিক জীবন মানুষকে করছে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন,এর নেতিবাচক প্রভাব পরে।  এছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রেমে ব্যর্থহয়ে আত্মহত্যাকে রোমান্টিজম হিসেবে দেখানো হয় সামাজিক মাধ্যমে যা আত্মহত্যা করার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাতে সাহায্য করে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যায়। এইসব ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে পরে মূলত কিশোরকিশোরী।

সমাজের যে কোন শ্রেনীর মানুষই হোক না কেন, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক তা কারো কাম্য নয়।  স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের অবশান ঘটুক এটাই সবার চাওয়া। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা  দিন দিন বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে।আত্মহত্যা প্রতিরোধে বেশি বেশি সরকারি বেসরকারি গবেষণা মানসিক সহায়তা দানকারী  সংগঠন প্রয়োজন, হোক সেটা আমাদের দেশ কিংবা অন্যকোন দেশ। বাংলাদেশে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের হেল্পলাইনের মাধ্যমে সাহায্য দেয়া বেসরকারি একটা সংগঠন হল ‘প্রেরক’ কিন্তু শুধু একটি নয় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী দরকার এমন আরও কয়েকটি সংগঠন।


নিউজ টি শেয়ার করুন..

সর্বশেষ খবর

আরো খবর