নিরাপত্তা, জরুরি সাহায্য কিংবা কোন অপরাধ সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছেন সাদ্দাম হোসেন। ‘সেলফ প্রটেক্ট’ নামের অ্যাপটি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহায়তাও চাওয়া যাবে। দেশীয় অ্যাপস ও সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সেলফ প্রটেক্ট-উইনকিটেক থেকে তৈরি অ্যপাটির মাধ্যমে উদ্যাক্তা হয়েছেন সাদ্দাম হোসেন।
শুরু করলেন যেভাবে
সাদ্দাম হোসেন লেখাপড়া করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে। ২০১২ সালের মার্চের কথা। ঢাকা থেকে ট্রেনে চেপে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে ফিরছিলেন সাদ্দাম। চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়। ট্রেন স্টেশন থেকে বাস ধরার জন্য একটু এগোতেই ছিনতাইকারীরা কেড়ে নেয় তার মোবাইল-মানিব্যাগসহ অন্যান্য সব জিনিস।
বাড়ি ফেরার টাকা নেই। মোবাইল না থাকায় যোগাযোগও করতে পারলেন না কারো সঙ্গে। খুব বিপদে পড়লেন সাদ্দাম। অনেক কষ্টে বাসায় ফিরেছিলেন সেদিন।
সাদ্দাম হোসেন বললেন, আমার মতো অসংখ্য মানুষ ছিনতাইকারী কিংবা অপহরণকারীর কবলে পড়ছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সময় খবরটা তাত্ক্ষণিক কিভাবে আপনজন বা আশপাশের পুলিশ প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকি।
কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ার ফলে মাথায় আসে এর সমাধান যেন ডিজিটাল মাধ্যমেই করা যায়। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ শুরু করি কিভাবে মোবাইল ব্যবহার করেই এর সহজ সমাধান করা যায়। আর তৈরি শুরু করেন একটি অ্যাপ। ২০১৪ সালে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে প্রশিক্ষণ চালু করে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নেন সাদ্দাম। এরপর টানা তিন বছরে দাঁড় করান অ্যাপটি। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে ব্যবহারের জন্য এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত সেলফ প্রটেক্ট অ্যাপ।
যেভাবে কাজ করে
সেবা পাওয়ার জন্য স্মার্টফোনে অ্যাপটি ইনস্টল করতে হবে। বিপদের সময় ফোনের পাওয়ার বাটনটি পর পর তিন-চারবার চাপলেই নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা সংস্থা ও স্বজনদের কাছে ওই মুহূর্তের কথাবার্তা ও অবস্থানের মানচিত্রসহ প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে যাবে। ফোন লক থাকা অবস্থায়ও কাজ করবে অ্যাপটি।
অ্যাপটির দুটি অংশ। একটি ক্লায়েন্ট বা ইউজার অ্যাপ। অর্থাৎ সবার মোবাইলে যে অ্যাপটি ডাউনলোড করা থাকবে। আরেকটি হচ্ছে নোটিফিকেশন রিসিভার ওয়েব অ্যাপ, এই অংশ থাকবে পুলিশের কাছে।
নাম, মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ই-মেইল, ঠিকানা ইত্যাদি দিয়ে নিবন্ধন ফরম পূরণ করলেই কাজ শুরু করবে অ্যাপটি। অ্যাপের সেটিংস অপশনে দুটি ইমারজেন্সি নম্বর দিতে হবে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে সেগুলোতে ফোন বা ম্যাসেজ যায়। বিপদের সময় মোবাইল ফোনের বাটন চাপলে নোটিফিকেশন কেন্দ্রীয় সার্ভারে পৌঁছাবে। কেন্দ্রীয় সার্ভার সাহায্য প্রার্থীর সবচেয়ে কাছের পুলিশ স্টেশনটির ওয়েব অ্যাপ ও মোবাইল নম্বর খুঁজে সেখানে নোটিফিকেশন ম্যাসেজ পাঠাবে। এ ক্ষেত্রে জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্যে অ্যাপটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাহায্যপ্রার্থীর অবস্থান নিশ্চিত করে আশপাশের শব্দ ও ছবি ধারণ করে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনের ওয়েব অ্যাপে পাঠাবে।
পুলিশ স্টেশনের ওয়েব অ্যাপের পাশাপাশি দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বরেও একই বার্তা পৌঁছাবে। অপরাধী সিম পরিবর্তন করলেও অ্যাপটি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই মোবাইল ফোনটির অবস্থান পুলিশের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও স্বজনদের নম্বরে চলে আসবে। এতে করে অপরাধীর অবস্থান জানা ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা যুক্ত আছে
এই অ্যাপের মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনি সহায়তা কেন্দ্র, মানবাধিকার কমিশন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সংস্থার কাছে প্রয়োজনীয় অভিযোগ ও মতামত জানানো যাবে। পাশাপাশি জরুরি সেবা, যেমন হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুল্যান্স, ব্লাড ব্যাংক ইত্যাদি সহায়তাও নেওয়া যাবে। জানা যাবে নিকটস্থ হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুল্যান্স, এটিএম বুথ, ব্যাংক, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মলের তথ্য ও ঠিকানাও।
শুরু হয়েছে অ্যাপটির ব্যবহার
পাইলট প্রকল্প আকারে মেহেরপুর জেলায় প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য জেলা পুলিশ সুপার অ্যাপটির পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছেন।
অ্যাপটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, জননিরাপত্তায় সেলফ প্রটেক্ট অ্যাপ ভূমিকা রাখবে। বিষয়টি নিয়ে স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে কীভাবে এটি সাহায্য করবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাবো আমরা।
অ্যাপটির প্রয়োজন কেন?
দেশে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ যেমন, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক পাচার, মানি লন্ডারিং, চাঁদাবাজি, ভাড়াটে খুন, প্রতারণা, মানব পাচার, ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, অপহরণ ইত্যাদি সংঘঠিত হয়। এসব অপরাধের প্রভাবে জনসাধারণের নিরাপত্তা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশ পুলিশের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত ২০১৭ সালে দেশে প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার ৬২৯টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অপহরণ, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধ রয়েছে।
অপরাধ সংঘঠনের সময় বা পরে দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করার মত তেমন সহজ কোনো সমাধানও ছিল না আগে। সম্প্রতি জাতীয় হেল্প ডেস্ক ৯৯৯ উন্মোচন হয়েছে। তবে এর পাাশাপাশি এসব অপরাধ নিয়ে দ্রুত প্রশাসনকে জানাতে অ্যাপটি উপকারে আসবে।
অর্জনের থলিতে যা কিছু
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ সেলফ প্রটেক্ট অ্যাপ তৈরির জন্য এটুআইয়ের ‘উদ্ভাবকের খোঁজে ২০১৭-তে ও সলভ-এ-থন-২০১৭ এ দেড় হাজার উদ্ভাবকের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত সেরা ১৫ উদ্ভাবকের একজন নির্বাচিত হয়।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুলনা বিভাগীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ও মেহেরপুর জেলা ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবনও হয় এটি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাদ্দামকে শতভাগ ওয়েবার বা স্কলারশিপ দেয়। বিনা টিউশন ফিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে লেখাপড়া করেন সাদ্দাম।
ডাউনলোড করতে
অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে http://bit.ly/SelfProtectApp অথবা https://www.selfprotectapp.com/ লিংক থেকে। এছাড়াও অ্যাপটি গুগলের প্লেস্টোরে পাওয়া যাবে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও কাজ করে অ্যাপটি। ফোন হারিয়ে গেলে খুঁজে পেতেও কাজে লাগবে এ অ্যাপ।