দ্যাটাইমসঅফবিডি.কম: ঢাকা -মঙ্গলবার-২১ আগস্ট ২০১৮ : ০৪ ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
সকালে হাতের ওপর অালতো স্পর্শে ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখি অামার স্বামী পাশে বসে অপলক তাকিয়ে অাছেন অামার দিকে। চোখ মেলতে দেখে নরম ধরা গলায় বললেন, “সেই ২১ অাগস্টে অামার বউ জীবিত ফিরে এসেছিল। অাল্লার কাছে কৃতজ্ঞ।” মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো ফিরে গেলাম সেই ভয়াল বিকেলে। গ্রেনেড অার গুলির বিকট শব্দ, বারুদ অার রক্তের গন্ধ, ধোঁয়া, অাহতদের অার্তচিৎকার, মানুষের ভয়ার্ত ছুটোছুটি, কান্না অার মৃত্যুর হাতছানি। অাবার চোখদুটো বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নীরবে বললাম, “বেঁচে অাছি, অামি কৃতজ্ঞ।” সাথে সাথেই মনে হলো অামি অাছি, অনেকেই অাছি, অাবার অনেকেই নেই। অাইভি চাচী নেই, অাদা চাচা নেই, কুদ্দুস নেই। অারও ১৯ জন নেই।
সেই প্রচন্ড ভীড়ে অামার সামনে গায়ের সাথে সেঁটে দাঁড়ানো মহিলা অাওয়ামী লীগের বোনটি নেই, যার রক্তে লাল হয়েছিলো অামার শাড়ী। সেদিন প্রথমে দাঁড়িয়ে ছিলাম ট্রাকটির পশ্চিম দিকে যেদিক দিয়ে নেত্রীর গাড়ী ট্রাকের ওপরে থাকা মঞ্চের কাছে অাসবে, যেখানে অাইভি চাচী দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর নেতা কর্মীদের নিয়ে। গাড়ী অাসবার কিছুক্ষণ অাগে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে দাঁড়ানো দু’জন ডাক্তার, অামি অার রোকেয়া অাপাকে ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন ভাই ডাকলেন ২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ এর অাওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঢোকার করিডোরের সামনের ফুটপাথে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। বহু কষ্টে ভীড় ঠেলে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নেত্রী এলেন। বক্তব্য রাখলেন বিএনপি জামাতের গ্রেনেড বোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অায়োজিত সে শান্তি সমাবেশে। বক্তব্য শেষের পরপরই শুরু হয় নারকীয় তান্ডব।
১৩ টি গ্রেনেড (তখন ভেবেছিলাম বোমা) ছোড়া হলো পরপর। নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে নেত্রীকে ঘিরে মানববর্ম তৈরী করেছিলো ট্রাকের ওপরে থাকা নেতৃবৃন্দ। অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেলেন প্রানপ্রিয় নেত্রী। গ্রেনেড দিয়ে তাঁকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে তারপর শুরু হয় তাঁর গাড়ীকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ। তখন চারদিকের নারকীয় বিভৎসতার মধ্যে প্রচন্ড চাপের মধ্যে বসে পড়তে চেষ্টা করলাম গুলি এড়াতে। এর মধ্যেই দু’জন ছাত্রলীগ কর্মী অামার দু’হাত ধরে অামাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। চারদিকে তখন লাশ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ, রক্তের বন্যা। হাজার হাজার জুতো স্যান্ডেল পড়ে অাছে। কয়েক হাত যাবার পরেই অাবার বিষ্ফোরণ। সে দু’জনের একজন চিৎকার করে বলেছিল, “অাপা, পিছেনে তাকাবেন না।” অামি যন্ত্রচালিতের মত পিছন ফিরে দেখলাম ঠিক কয়েক মুহূর্ত অাগেই যে স্থানটিতে ছিলাম সেখানে লাশ পড়ে অাছে। রাস্তার কোনাটি ঘোরার অাগেই বাঁদিকে দেখলাম দু’জন জিল্লুর চাচাকে অাগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর হতবিহ্বল দু’চোখ মুহূর্ত অাগেই দেখেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর রক্তে ভেজা দেহ। রাস্তার মোড় ঘুরেই নির্মিয়মান বহুতল একটি ভবনের বেসমেন্টে ঢুকলাম। নানক ভাই, লাইলী অাপাসহ অারও অনেকে সেখানে। ভেতর থেকে বন্ধ থাকা একটি অফিসকক্ষে অনেক অনুরোধ করে দরজা খুলিয়ে ভেতরে গেলাম। সবার একই উৎকন্ঠিত প্রশ্ন, নেত্রী কেমন অাছেন? বেঁচে অাছেন তো? নিজেদের বিধ্বস্ত রক্তাক্ত অবস্থার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, শুধু নেত্রী ঠিক অাছেন, এটুকু জানার জন্য উন্মুখ সকলে। নানা জায়গায় মোবাইলে খোঁজ নিচ্ছেন সবাই। প্রায় ফুরিয়ে এসেছে মোবাইলের চার্জ। বাসায় ফোন করে জানালাম, বেঁচে অাছি, বাসায় ফিরবো।
বাইরে তখন অাহতদের সহযোগিতা করার বদলে চলছে পুলিশের লাঠিচার্জ অার টিয়ার শেল নিক্ষেপ। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। অনেকের নিষেধ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম। খালি পা, রক্তমাখা ছেড়া শাড়ী। পুলিশের সামনে দিয়েই হেঁটে রওনা হলাম। তাকিয়ে দেখলো, কিছু বললো না। পাশ দিয়ে দেখলাম অনেকগুলো দেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে একটি পিকঅাপ ভ্যান। তার মধ্যে কেউ জীবিত ছিল কি না জানিনা। হাঁটতে হাঁটতে সচিবালয়, হাইকোর্ট, মৎস্যভবন, কাকরাইল, রমনা পার্ক পেরিয়ে শেরাটন হোটেলে গিয়ে পৌঁছুলাম। অামার গাড়ী সেখানে রাখা ছিলো। পথে উৎসুক কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, কি হয়েছে, কোথায় যাচ্ছেন। হামলার কথা শুনে বিচলিত হয়েছেন। কোন সাহায্য লাগবে কি না জানতে চেয়েছেন। মাথা নেড়ে হেঁটে চলেছি একটানা। হোটেলের ভেতরে ঢুকে লবীর দিকে যখন যাচ্ছি সাংবাদিক শফিকুর রহমান ভাইর সাথে দেখা। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন। বললেন কিছু একটা ঘটেছে শুনেছেন। ছেলে টিউটরের কাছে শুনে ছুটে বেরিয়ে এসেছে মায়ের খোঁজে, মেয়েকে বন্ধুর বাড়ী থেকে অানা হয়েছে অামার মায়ের বাড়ীতে। সেখান থেকে বাসায় অাসতে অাসতে ১১ বছরের মেয়ের রাজনীতি এতো ভয়ংকর, এতো ঝুঁকিপূর্ণ হলে কেন রাজনীতি করি, এ প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করেছি। কলাবাগান থেকে উত্তরা, এই পথ পেরুনোর সময়টুকুতে অামার উত্তরে সন্তুষ্ট এবং উদ্বুদ্ধ মেয়ে বাসায় পৌঁছে ঘরে ঢুকেই বাবাকে বলেছে, “বড় হয়ে অামি রাজনীতি করবো, বাবা।” হাসপতালে অাহতদের চিকিৎসা যেন না পাওয়া যায়, অকুস্থলে কোন হামলার অালামত যেন পাওয়া না যায়, হামলাকারীদের যেন চিহ্নিত করা ও বিচার করা না যায়, এতোবড় হামলা ঘটেছে বিরোধীদলের নেত্রীর ওপর, পুরো বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য, তা নিয়ে সংসদে যেন কোন অালোচনা না হয়, তার সব ব্যাবস্থা করেছিলো খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামাত সরকার। বরং মিথ্যাচার, জঘন্যতম মিথ্যাচার করেছিলো, শেখ হাসিনাই নাকি তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ এ করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে নিজেদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। সাজানো হয়েছিলো জজ মিয়া নাটক। শহরের নানা হাসপাতাল অার ক্লিনিকে যে যেখানে পেরেছে চিকিৎসা নিয়েছে।
বেগম অাইভি রহমানকে ঢাকা সিএমএইচ এ রেখে চালানো হয়েছে অারেক মর্মান্তিক নাটক। বেগম জিয়া তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাবার নির্মম নাটক করেছিলেন। অাইভি চাচীর ছেলেমেয়েদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল সেসময়। গভীর রাতে ফোন করে তাঁর ছেলেকে বলা হয়েছে তার মা মারা গেছেন, তক্ষুনি নিয়ে যেতে হবে লাশ হাসপাতাল থেকে। যারা হারিয়ে গেছেন চিরদিনের জন্য তাদের শোকার্ত পরিবারের কান্না, যারা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে অাহত হয়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল তাদের অার্তনাদ বেগম জিয়াকে বা তার পরিবারের, দলের ও সরকারের ষড়যন্ত্রকারীদের স্পর্শ করেনি।
লেখক: ডা: দীপু মনি, এ সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী।