নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও যাত্রী ও মালবাহী চলন্ত রেলের তেল চুরি এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অভিনব পন্থায় চোর চক্র এই তেল চুরি করে। রেলে সারা বছরে চুরি হয় প্রায় দেড় কোটি লিটারের বেশি তেল, যার বাজারমূল্য প্রায় শত কোটি টাকা (১ লিটার ৬৫ টাকা হিসাবে)।
চলন্ত ট্রেন, ইঞ্জিন, পাওয়ার কার এবং লোকো শেড থেকে এ চুরির ঘটনা ঘটছে। দেশের ৬০টির বেশি স্পটে শতাধিক সিন্ডিকেট এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সুযোগ সন্ধানী চক্র ‘ঝোপ বুঝেই কোপ’ চালাচ্ছেন রেলের ওপরে। তবে অসাধু ওই চক্রকে ঠেকাতে থেমে নেই রেলপথ কর্তৃপক্ষ। নতুন নতুন পন্থা এবং প্রতিরোধে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, এগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হলে চলন্ত রেলের তেল চুরি শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
জানতে চাইলে রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন দ্যা টাইমস অফ বিডি কে বলেন, চলন্ত রেলের চুরি ঠেকানোর ব্যাপারে আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। চুরিরোধে সর্বশেষ যে প্রক্রিয়াটি আমরা অনুসরণ করছি সেটা হলো আমাদের সব রেল ইঞ্জিন ক্যালিব্রেশন বা ক্যালিব্রেটেড করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ইঞ্জিনটা ১ কিলোমিটার কিংবা ১০ কিলোমিটার চলতে কতটুকু তেল লাগবে এবং প্রত্যেকটি তেল ট্যাঙ্কারের সঙ্গে স্কেল লাগানো আছে। তিনি বলেন, কোনো ইঞ্জিন যখন অন্য একজন ব্যক্তি লোকোশেড থেকে চালক রিসিভ করেন এবং ওই পর্যন্ত যেতে কতটুকু তেল খরচ হয়েছে তা পরিমাণ করে সংশ্লিষ্ট চালক তা স্বাক্ষর করেন। পাশাপাশি এই ট্রেনটির যে ডেসটিনেশন আছে সেখানে পৌঁছানোর পর ওই লোকোশেডে গিয়ে তার তেলের হিসাবটি বুঝিয়ে দেন। দেখা হয়, এই ইঞ্জিনে কী পরিমাণ তেল খরচ হয়েছে। যদি বেশি খরচ হয় তাহলে যিনি চালক এটি বহন করে এনেছেন তার বেতন থেকে বাড়তি তেল খরচের টাকা কর্তন করা হয়। কিন্তু কোনো চালক তেল সাশ্রয় করলে তাকে আমরা পুরস্কৃত করি না; ভালো কাজের জন্য রিওয়ার্ড দেওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা হচ্ছে, যোগ করেন সচিব। তিনি আরো বলেন, আমি এই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে আসার পর ওই পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে তেল চুরির বিষয়টি অনেকাংশে রোধ হয়েছে। তবে পুরোপুরি বন্ধে আরো কিছু সময় লাগবে।
আর পূর্বাঞ্চল রেলপথের মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছুসংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার তেল চুরি হয়ে যাচ্ছে। চুরিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এমনকি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলো আমরা বাস্তবায়ন করছি। তাদের সুপারিশের মধ্যে লোকোমোটিভে যে ট্যাঙ্কার থাকে তাতে তালা-চাবি ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে তালা-চাবির ব্যবস্থা করছি। এখন পর্যন্ত ২৫-২৬টিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চুরির সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি যারা চোরাই তেল বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রেলওয়ে পুলিশসহ স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে পশ্চিমাঞ্চলের জিএমের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, সারা দেশে প্রতিদিন ৩৫০টি ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পৌনে ২ লাখ লিটার ডিজেল খরচ হয়। এ হিসাবে বছরে ব্যয় হয় ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার লিটার। কোনো কোনো বছর এর চেয়ে কম-বেশি ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এই ব্যবহৃত তেল থেকে বছরে চুরি হয়ে থাকে প্রায় দেড় কোটি লিটার। যার বাজারমূল্য ৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা (১ লিটার ৬৫ টাকা হিসাবে)। গড়ে প্রতিদিন চুরির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার লিটার।
এর মধ্যে শুধু ইঞ্জিন ও পাওয়ার কার থেকে দিনে ২০ হাজার লিটার, ১১টি লোকোশেড থেকে প্রায় ১৫ হাজার লিটার এবং চলন্ত ট্রেন থেকে ৫ হাজার লিটার তেল চুরির ঘটনা ঘটে। এছাড়া বছরে প্রায় ১ কোটি টাকার মবিলও চুরি হয়। তেলের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে চুরি অর্থ নির্ধারণ হয়। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে এর ভাগ চলে যায়। তবে কখনো কখনো ট্রেনচালক ও গার্ডদের জিম্মি করেও তেল চুরি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেখা গেছে, তেল চুরির অপরাধে বিভিন্ন সময়ে চুরি চক্র হাতেনাতে ধরা পড়েছে। আবার চুরির অপরাধে শাস্তি হয়েছে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এত কিছুর পরও চুরি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছর নাটোরের লালপুরে অভিযান চালিয়ে রেলের তেল চুরি চক্রের প্রধান হাফিজুলসহ পাঁচজনকে আটক করে র্যাব। এ চক্রের কাছ থেকে ১৩৮০ লিটার তেল উদ্ধার করা হয়। ওই বছরেই দিনাজপুর পার্বতীপুরে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে তেল পাচারের ঘটনায় আবদুল কাদের জিলানী ও সহকারী চালক মিজানুর রহমান নামের দুই চালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
রেলের এই চুরি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি চুরিরোধে বেশকিছু সুপারিশ জানায়। এসব সুপারিশের মধ্যে তেল চুরি রোধকল্পে ফুয়েল ট্যাঙ্কে তালা-চাবির মাধ্যমে লোকিংয়ের ব্যবস্থা করা, লোকোশেডে প্রতিটি লোকোমোটিভের ফুয়েল ট্যাঙ্কে তেল ভরার পরে ফুয়েল ট্যাঙ্কের ক্যাপ লাগিয়ে তালা-চাবি বন্ধ করে তা সংরক্ষণের জন্য লোকোমাস্টারের কাছে জমা রাখা ও লোকোমাস্টার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পরে চাবিটি সংশ্লিষ্ট লোলোশেডে বা পরবর্তী লোকোমাস্টারের কাছে হস্তান্তর করা এবং পথিমধ্যে দুষ্কৃতকারী তেল চুরির লক্ষ্যে তালা-চাবি ভেঙে ফেললে লোকোমাস্টার দ্রুত তা সংশ্লিষ্ট কন্ট্রোলকে জানাবেন। এছাড়া মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে দৈনিক কয়েক লাখ টাকার তেল চুরিরোধ করতে। এত কিছুর পরও এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি চলন্ত রেলের তেল চুরি।
এদিকে দুই অঞ্চলে থাকা ১১টি শেড থেকে বেশি চুরি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, শেডগুলোতে যখন ট্রেন শানটিং করা হয় তখন ইঞ্জিন ও পাওয়ার কারে বিশেষ কায়দায় তেল রাখা হয়, যা পরে বিক্রি হয়ে যায়। আবার শেডে হিসাবের বাইরেও তেল জমা হয়, যা পরে মালবাহী কিংবা যাত্রীবাহী ইঞ্জিনে সরবরাহ করা হয়। এ কাজে শেডের কর্মকর্তা এবং চালকরা উভয়ই আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ইঞ্জিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল রাখতে হয়। চালকরা যখন ট্রেন থেকে বেশি তেল বিক্রি করে ফেলেন তখন শেডে এসে তা পূরণ করে নেন। শেডে থাকা অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন ইঞ্জিন থেকে কম টাকায় তেল কিনেও রাখেন।