অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতকে বলা হলো, আপনি এবার নিয়ে টানা দশবারের মতো বাজেট দিতে যাচ্ছেন। এর আগেও আপনি দুটি বাজেট দিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রী হিসেবে আপনার একটা বড় রেকর্ড। কথাটা শুনে তিনি বললেন, ‘ও ইয়েস অফকোর্স ইট ইজ আ গ্রেট রেকর্ড। নট অনলি দ্যাট ইটস আ ভেরি গুড থিঙ্ক ফর ডেমোক্র্যাসি। অ্যান্ড ইটস পসিবল অনলি আন্ডার ডেমোক্র্যাসি।’ গণতান্ত্রিক দেশ ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এর আগে মরিশাসের অর্থমন্ত্রী রিঙ্গাদু একাধারে ১৭ বছর অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বোধহয় তাও ছিল একটা বিশ্বরেকর্ড। এরপর আমারটাও হয়তো বিশ্বরেকর্ডই হবে। আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। ঠিক এই সময়টায় গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে তাঁর কার্যালয়ে এক সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি জাতীয় বাজেট, অর্থনৈতক বৈষম্য, কালো টাকা সাদাকরণ, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, সরকারের টানা প্রায় ১০ বছরের শাসন, বিএনপির রাজনীতি ও নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার দ্রুত গতিতে কমছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৪১ সালের আগেই আমরা উন্নত দেশের কাতারে চলে যাব। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমি হয়তো তখন থাকব না। কিন্তু এটা একটা বড় প্রশান্তি যে, মানুষ এখন অনেক সুখে-শান্তিতে রয়েছে। গত ১০ বছরে মানুষের আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। সর্বশেষ হিসাবমতে দেশের মানুষের গড় আয় এখন দাঁড়িয়েছে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে। তবে আয়বৈষম্য বেড়েছে। এ কথা আমি আগেই বলেছি। আজও বলছি। আমাদের আয়বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। একে একটা সমতার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষদের তুলে আনতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। সেসব অঞ্চলের বাজেট বরাদ্দও বাড়ানো হচ্ছে বছর বছর। আপনি প্রতি বছরই অনেক বড় আকারের বাজেট দেন আবার তা সংশোধন করে কমিয়ে আনেন। তখন বিশাল আকারের বাজেটকে অনেকেই উচ্চাভিলাষী বলেন এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো বলি আমার সব বাজেটই উচ্চাভিলাষী। এবারও তাই হবে। এ বছর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নকে আমরা অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। আর চলমান মেগা প্রকল্পগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সেদিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে। কেননা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে এবং আমরা সে চেষ্টাই করছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের খরচ বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও হচ্ছে এটা বাজেটে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলছে কিনা— জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই। ইতিমধ্যে এ খাতে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যদিও তা বিদেশি সহায়তা হিসেবে পাওয়া গেছে। তবে ভাসানচরে যে কাজটা করা হচ্ছে সে টাকা তো বাজেট থেকেই দেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটেও তো কিছু বরাদ্দ রাখতে হব। রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে প্রতি বছর আমাদের ১ বিলিয়ন ডলার বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে; যা আমাদেরই সরবরাহ করতে হবে। তবে মিয়ানমার একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছে। আবার আন্তর্জাতিক মাধ্যমকেও কেয়ার করছে না। এটা তাদের সন্ত্রাসী মনোভাবের কারণে হচ্ছে। আমরা চাইলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ নাও দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে হয়তো মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধই লেগে যেত। এমনিতেই তো মিয়ানমার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা তাদের থাকতে দিয়েছি। এখন যে কোনো মূল্যে ফেরত তো নিতেই হবে। ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে তিনি বলেন, দেখুন এখানে আমাদের ব্যাংকিং খাতের দুটি দিক রয়েছে। এর একটি সরকারি আর অন্যটি বেসরকারি। সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এনপিএল অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি বলা হয়, আমাদের দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু আমি তা মনে করি না। কারণ, আমাদের যে জনসংখ্যা সে তুলনায় ব্যাংক আরও বেশি প্রয়োজন। এখন বোধহয় সারা দেশে সব ব্যাংকের ৯ হাজারের মতো শাখা রয়েছে। এসব শাখা দিয়ে কি সব মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে? আমি বলব, না, সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য আমাদের আরও ব্যাংক প্রয়োজন। তবে এটা ঠিক, ব্যাংকে এক ধরনের নৈরাজ্য বিরাজ করছে। এজন্য এবার বাজেট বক্তৃতায় একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের রূপরেখা দেওয়া হবে। বাজেটে বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বলেন, এটা তো আমদের আইনেই রয়েছে যে, জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। সেখানে তো আমার কিছু করার নেই। কিছু করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। আপনি ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বলে আসছেন দেশে বৈষম্যটা প্রকট। এটা কমাতে হবে। এমনকি বাজেট বক্তৃতায়ও আপনি বৈষম্য কমানোর কথা বলে আসছেন, এ ক্ষেত্রে কতটা সফল হতে পেরেছেন— জবাবে তিনি বলেন, বৈষম্য তো আছেই। এটা রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়। তবে এর জন্য একটা বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, জনগণ আওয়ামী লীগকেই চায়। আমরা আবারও ক্ষমতায় আসব। আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময়ে দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মানুষ চায় দেশের উন্নতি। বিএনপি দেশের ভালো চায় না। বিএনপি দল হিসেবেও শেষ হয়ে গেছে। ফলে আগামী নির্বাচনে বিজয় আমাদেরই হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ।